হাজীগঞ্জে পরিদর্শিকার ভুলে কী মারা গেলো হাফসা?


ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুই পরিদর্শিকার মধ্যে কোন্ পরিদর্শিকার ভুলে ডেলিভারীর সময় মারা গেলো তরুণী মা হাফসা (১৯)-সেটিই এখন প্রশ্ন। ডেলিভারীর ব্যথায় যখন একমাত্র মেয়েটি ছটফট করছে আর বারবার অসহায় মায়ের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে তখন মা শুধু ছুটে চলেছেন এই পরিদর্শিকা থেকে সেই পরিদর্শিকার কাছে। ছুটে গেছেন চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে আর সেখান থেকে লাশ নিয়ে আসতে হয়েছে বাড়িতে। যার কাছে গিয়েছেন সে তার মতো করে দেখেছেন, দায়িত্ব নিয়ে কেউ দেখেননি। দায়িত্ব নিয়ে দেখলে হয়তো মেয়েকে হারাতে হতো না বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন মা হাছিনা। গত শুক্রবার রাতে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে হাজীগঞ্জের বাকিলা এলাকায়। চলে যাওয়া মা হাফসার রেখে যাওয়া ছেলে সন্তানটি বুকের দুধের অভাবে মরতে বসেছে। এক পরিদর্শিকা হাফসাকে সময় মতো দেখেননি, আরেকজন রোগীকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে নিজ বাড়িতে ডেলিভারী করিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাজীগঞ্জের বাকিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত রয়েছেন শাহনাজ বেগম। তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংলগ্ন সরকারি কোয়ার্টারে বাস করেন। এই কোয়ার্টারের প্রায় ৫০ গজ পিছনে নিজের বাড়িতে থাকেন মাহমুদা আক্তার। মাহমুদা আক্তার কর্মরত আছেন চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা হিসেবে। অন্য উপজেলায় কর্মরত থাকলেও মাহমুদা আক্তার নিজের বাড়িতে বসবাস করেন, আর দীর্ঘদিন ধরে ডেলিভারী করিয়ে থাকেন। নিহত হাফসার মা হাছিনা বেগম সেদিন এই দুই পরিদর্শিকার কারো কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাননি, উল্টো মেয়েকে লাশ বানিয়ে বাড়িতে গেছেন বলে অভিযোগ করেন। তবে শাহনাজ বেগমের চেয়ে মাহমুদা আক্তারের কাছ থেকেই অমানবিক ব্যবহার বেশি পেয়েছেন মা-মেয়ে দুজনেই। মেয়ের ডেলিভারী শেষে ৩ হাজার টাকা দিয়েও মন ভরাতে পারেননি মাহমুদা আক্তারের। ডেলিভারীর আগে বারবার মেয়েকে চাঁদপুরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন, কিন্তু মাহমুদা আক্তার কোনোভাবেই রোগী রেফার দেননি-ঠিক এমনটাই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন নিহতের মা হাছিনা বেগম।
নিহত হাফসা হাজীগঞ্জের বাকিলা ইউনিয়নের সাতবাড়িভাঙ্গা গ্রামের বাহরাইন প্রবাসী আঃ মালেক মিয়ার স্ত্রী ও পাশের লোধপাড়া গ্রামের আবুল হোসেন ও হাছিনা দম্পতির একমাত্র কন্যা সন্তান।
হাফসার মা হাছিনা বেগম জানান, গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে মেয়ের প্রসব ব্যথা উঠলে বাকিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা শাহনাজ বেগমের কাছে ফোন দিলে বলেন সকালের দিকে নিয়ে যেতে। সকাল ৭টার দিকে হাসপাতাল কমপ্লেঙ্ েএসে দীর্ঘক্ষণ মা-মেয়ের অপেক্ষা। এর পরে হাছিনা বেগম নিজে গিয়ে পাশের কোয়ার্টারে থাকা শাহনাজের দরজা বারবার নাড়তে থাকেন কাকুতি-মিনতি করে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। এক সময় দরজা খুলে বলা হলো, আজ শুক্রবার আপনারা জানেন না? আরো অনেক অনেক রূঢ় কথা। এর পরেই পুরো হাসপাতালের চাবি দিয়ে হাছিনাকে বলা হলো, যান গিয়ে দরজা খুলে বসেন। মা হাছিনা দরজা খুলে মেয়ের প্রচ- প্রসব ব্যথা নিয়ে বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু শাহনাজ আক্তারের আসার খবর নেই। এক পর্যায়ে মেয়ের প্রচ- ব্যথা আর চিৎকার সহ্য করতে না পেরে মেয়েকে হাসপাতালে বসিয়ে রেখে হাসপাতালের পাশের বাড়িতে সেই রামপুর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা মাহমুদা আক্তারের কাছে যান। মাহমুদাকে বিস্তারিত খুলে বললে মাহমুদা আক্তার রোগীকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেন।
হাছিনা বেগম জানান, শুক্রবার বেলা প্রায় ১১টার দিকে মেয়েকে মাহমুদা আক্তারের কাছে নিয়ে গেলে মাহমুদা চেকআপ করে বলেন, সব ঠিক আছে, তবে ডেলিভারী হতে অনেক দেরি হবে। রোগী এখন নিয়ে যান। প্রচ- ব্যথা নিয়ে রোগীকে বাড়িতে নিয়ে আসি। বাড়িতে নিয়ে গেলে ব্যথা না কমার কারণে বিকেলে ফের বাকিলায় মাহমুদা আক্তারের বাড়িতে নিয়ে আসি। এ সময় মাহমুদা উল্টাপাল্টা কথা বলতে শুরু করলে আমরা রোগী চাঁদপুরে সিজার করানোর কথা বলতেই ক্ষেপে গেলেন মাহমুদা। জামাইয়ের টাকা আছে, যান নিয়ে যান, আমার এখানে ওমুকে ডেলিভারী হয়েছে, তমুকে ডেলিভারী হয়েছে বলে আমাদেরকে অনেক অনেক বাজে কথা বলেন। এতো কিছুর মধ্যে মেয়েটির চিৎকার, বাঁচার আকুতি থেমে ছিলো না। এরই মধ্যে ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে হাফসার ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হয়। এর পরেই বাকি কাজটুকু সেরে মাহমুদা আক্তার আমাদেরকে বাড়ি চলে যেতে বলেন।
মাহমুদাকে টাকা দিতে গেলে ঘটে আরেক বিপত্তি। তাকে ৩ হাজার টাকা দেওয়ার পরেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন মাহমুদা। অনেক অনুনয় বিনয় করে সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশার জন্য বাকিলা বাজারে লোক পাঠাই।
আসরের নামাজের কিছু পরে সিএনজি অটোরিকশা আনার ফাঁকে মাহমুদা আক্তার আমাকে বলেন, আপনার মেয়েকে এখনই চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান, তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা একটি গাড়িতে করে ইফতারের সময়ে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে পেঁৗছি। সেখানে ইফতারের অজুহাতে কেউ আমার মেয়ের চিকিৎসায় এগিয়ে আসেনি। রাত প্রায় ১১টার দিকে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার আমাদেরকে বলেন, রক্ত ম্যানেজ করতে আর এর পরেই হাসপাতালের ডাক্তাররা ডেলিভারীর স্থানে সেলাই করেন। ডাক্তারের কথামতো রক্ত সংগ্রহ করি। এর পরেই এই ডাক্তাররা আমার মেয়েকে কুমিল্লা রেফার করেন, আর কুমিল্লা নেয়ার পথে হাফসা মারা যায়।
মুঠোফোনে কথা হয় মাহমুদা আক্তারের সাথে। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, শুক্রবার সকালে আমার কাছে নিয়ে আসলে আমি ফেরত দেই। পরে আবার বিকালে নিয়ে আসলে নরমাল ডেলিভারিতে হাফসার পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর সে অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমি তাকে চাঁদপুর হাসপাতালে রেফার করি।
এ দিকে 'দায়িত্বশীল ব্যক্তি হওয়ার পরও স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়িতে কেন ডেলিভারী করা হয়েছে' এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন নি মাহমুদা আক্তার।
বাকিলা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা শাহনাজ আক্তার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, হাফসাকে নিয়ে আসলে তার স্বজনদের কাছে আমি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও কল্যাণ কেন্দ্রের দরজা খোলার জন্য চাবি দেই। এরপর আমি প্রস্তুত হতে এবং পিপিই পরতে একটু সময় লেগে যায়। পরে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে দেখি, তারা (হাফসা ও তার স্বজনেরা) নেই।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডাঃ এমএ গফুর মিয়া জানান, অভিযোগ পেলে বিধি অনুযায়ী মাহমুদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ গোলাম মোস্তফা জানান, শাহনাজের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। মাহমুদার বিষয়ে তিনি বলেন, জানামতে এর আগেও তাকে দায়িত্ব অবহেলার দায়ে সর্তক করা হয়েছে।
জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ডাঃ মোঃ ইলিয়াছ মুঠোফোনে জানান, তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, এর আগেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা মাহমুদা আক্তারকে কয়েকটি বিষয়ে সর্তক করা হয়েছে এবং তাকে শোকজও করা হয়েছে।