• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

এরা করোনা যুদ্ধের সম্মুখ যোদ্ধা

বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তাদের প্রতি

প্রকাশ:  ১৯ এপ্রিল ২০২০, ১৪:৫৩ | আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২০, ১৫:২২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

কোভিড-১৯ তথা করোনা ভাইরাস এমন এক ছোঁয়াচে রোগ যা একজন থেকে অসংখ্যজনকে সংক্রমিত করতে পারে। এই মহামারী এখন বিশ্বের প্রায় আড়াইশ' দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। আর মারা গেছে ৮৪ জন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে। গত শুক্রবার একদিনে মারা গেছে ১৫ জন। এটিই একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর সংখ্যা।


কোনো মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলো কি না তা নিশ্চিত হতে তার নাক এবং গলার ভেতর থেকে নিঃস্বরণ নিয়ে তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হয়। যাকে বলা হয় সেম্পল বা নমুনা। অবশ্য এই নমুনা সংগ্রহ ওই ব্যক্তি থেকেই করা হয় যার মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। চাঁদপুরে এই নমুনা সংগ্রহ করে থাকেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ এবং জেলা সদর হাসপাতালের ল্যাব টেকনিশিয়ানগণ। তবে এর জন্যে পূর্ব থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখতে হয়।

 


এদিকে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও সংস্পর্শ থেকে এই রোগ অন্যদের সংক্রমিত করে। তাই এই রোগীর কাছাকাছি যাওয়া মানে এই ভাইরাসটাকে আলিঙ্গন করে নিজেও আক্রান্ত হওয়া। তাই তো এটি নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন আরো কতো কী সতর্কতা। অথচ ভয়াবহ এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে যাচ্ছেন ল্যাব টেকনিশিয়ানগণ। নিজেও প্রাণঘাতী এই মহামারী ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন এমন সমূহ আশঙ্কা নিয়েই তাঁরা সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাক এবং গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আসছেন। তাই তো এদেরকে করোনা যুদ্ধের 'সম্মুখ যোদ্ধা' বলা হচ্ছে। যখন নমুনা সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নেয়া হয় এবং নমুনা সংগ্রহ করা হয়, সে দৃশ্য দেখলে যে কারোরই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাবে, যে কেউই আতঙ্কিত হয়ে যাবেন। তারা যে বিশেষ পোশাকটি পরেন, তাকে পিপিই বলা হয়। এই পোশাকটি দ্বারা নিজেকে এমনভাবে আবৃত করতে হয়, যেনো বাইরে থেকে কোনো ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীবাণু তার শরীরে প্রবেশ করতে না পারে। পুরো পোশাক দ্বারা নিজেকে আবৃত করলে অনেকটা নভোচারীর মতই মনে হয়। সবচেয়ে ভীতির বিষয় হচ্ছে, ওই সন্দেহভাজন লোকের নাকের ভেতর থেকে যখন আলামত সংগ্রহ করা হয়, সে মুহূর্তে যদি সে ব্যক্তি হাঁচি বা কাশি দেয়, তখন ওই টেকনিশিয়ানের ভেতর যে কী পরিমাণ ভয় কাজ করে, তা সেই ব্যক্তিই অনুভব করতে পারেন। এমন এক ভয়ানক ঝুঁকি নিয়েই মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন টেকনিশিয়ানগণ।

 


চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, চাঁদপুর জেলায় এ ধরনের টেকনিশিয়ান রয়েছেন মোট ১১ জন। আট উপজেলায় ৮জন, আড়াই শ' শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে ২জন এবং সিভিল সার্জন কার্যালয়ে একজন। এঁদেরকেই এখন প্রত্যেকদিন করোনা সন্দেহভাজন ব্যক্তির স্যাম্পল কালেকশন করতে হয়। কোনো কোনো উপজেলায় একেকদিন ৪/৫ জনের নমুনা সংগ্রহ করতে হয়। আর একেকটি নমুনা সংগ্রহের জন্যে প্রস্তুতি নিতে ২/৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এর জন্যে আবার নির্দিষ্ট কীট সংগ্রহেও থাকতে হয়। এসব কীট ঢাকা থেকে আনতে হয়। সিভিল সার্জন জানান, এ পর্যন্ত চাঁদপুর জেলায় একদিনে সর্বোচ্চ ৩৮টি স্যাম্পলও কালেকশন করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে এমনও হয় যে, রাত ১১টা পর্যন্ত বেজে যায় সব কাজ শেষ করতে। এরপর পরের দিন ঢাকা পাঠানো হয় এসব স্যাম্পল পরীক্ষার জন্যে। ২/৩ দিন পর এসবের ফলাফল আসে। তিনি আরো জানান, স্যাম্পল কালেকশন করতে গিয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্রে ল্যাব টেকনিশিয়ানও করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেছেন। এছাড়া মতলব উত্তরে একজন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে।

 


চাঁদপুর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন জানান, আমার উপজেলায় টেকনিশিয়ান না থাকলেও সহকারীকে ট্রেনিং দিয়ে তাকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। যেহেতু আমার উপজেলায় আলাদা কোনো হাসপাতাল নেই, তাই ল্যাবও নেই। এই সহকারী দিয়েই আমি কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। তিনি স্যাম্পল কালেকশন করার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বলেন, আসলে এটা খুবই ঝুঁকির কাজ। খুব সাহসী এবং মানুষের সেবার জন্যে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করার মতো লোক ছাড়া এ দুঃসাহসিক কাজ করা সম্ভব নয়। একেকবার তারা হাঁফিয়ে ওঠেন। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আবার স্যাম্পল কালেকশন করার ডাক আসে, তখন তাঁদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তখন যেনো নিজেরই চোখের পানি চলে আসে। তাঁদের চোখে-মুখে তখন এমনই বিষাদের ছায়া নেমে আসে। তারপরও তারা চাকরির কারণে, বসের মন রক্ষার্থে সর্বোপরি 'তার এই একটি স্যাম্পল কালেকশন করার কারণে হয়ত একজন মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারে' এ মানসিকতা থেকেই শেষ পর্যন্ত তারা দৃঢ় মনোবল নিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতে যান। আর এর জন্যে তাঁদের সাথে খুব ভালো আচরণ এবং অভিভাবকসুলভ আচরণ দ্বারাই তাঁদেরকে ম্যানেজ করে রাখতে হয়। এভাবেই খুব কঠিন সময় পার করছি আমরা। এ বিষয়টি আমাদের মতো যারা এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন, তারাই উপলব্ধি করতে পারছেন। তারপরও কোথাও কোথাও সেম্পল কালেকশন করতে যেতে একটু দেরি হলে অনেকের কটু কথা শুনতে হয় বলে দুঃখ প্রকাশ করেন সিভিল সার্জন।

করোনা যুদ্ধের এই সম্মুখ যোদ্ধা ক'জনের সাথে কথা হলে তারাও একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। মূলত তারা মানবসেবার মানসিকতা থেকেই এই প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিয়েও কাজটি করে যাচ্ছেন। কিন্তু কষ্ট হয় তখন, যখন ঘটনাস্থলে যেতে যৌক্তিক কারণে একটু দেরী হলে যখন কটু কথা বলে।

তবে অনেক মানুষ যারা এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি দেখেছেন অথবা জেনেছেন, তারা এসব সম্মুখ যোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছেন।

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ