• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

রেলওয়ের সম্পদ বিক্রি করে জাকির এখন কোটিপতি!

চাঁদপুর কোর্ট স্টেশন এলাকায় রেলভূমির লীজ গ্রহীতা থেকে ক্রয়কৃত মালিককে ভাড়াটিয়া বানিয়ে অতঃপর উচ্ছেদ

প্রকাশ:  ১৫ অক্টোবর ২০১৯, ০৯:১৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুরে রেলভূমির লীজ গ্রহীতা আলী আকবর মিজির কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে মালিক জুলহাস বেপারীকে ভাড়াটিয়া বানিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোর্ট স্টেশন এলাকার রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সম্পদ কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করে জাকির হোসেন বেপারী এখন চাঁদপুরের নতুন কোটিপতি হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে! যে কোনো সময় জাকিরের মা থেকে লীজকৃত সম্পত্তির ক্রেতারা রেল কর্তৃক উচ্ছেদ হয়ে প্রতারণার শিকার হতে পারে বলে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা গেছে। মূল লীজ গ্রহীতা আকবর মিজি থেকে সম্পত্তি কিনেন মোঃ জুলহাস বেপারী। পরে তিনি স্ট্যাম্প করে এ সম্পত্তি ভাড়া দেন আঃ কুদ্দুছ বেপারীর কাছে, যিনি এ সম্পত্তিতে চাঁদপুর হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলে পরিচালনা করেন। অথচ রেলওয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে আঃ কুদ্দুছ বেপারীর মৃত্যুর পর ছেলে জাকির হোসেন বেপারী ৬টি দোকান কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। এ বিক্রির বিষয়টির সত্যতা এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি স্বীকার করেছেন।
এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে রেলওয়ের আরো দোকান বিক্রির পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে জাকির হোসেন বেপারী গং। এ বিষয়টি নিয়ে এখন সর্বমহলে ঝড় উঠেছে। সকলের একটাই কথা, এ জাকির হোসেনের খুঁটির জোর কোথায়?
বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তির অফিস সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে বাংলাদেশ রেলওয়ের কোর্টস্টেশন এলাকায় রেলওয়ের কর্মচারীদের রেশন দেয়া হতো একটি গোডাউনে। সে গোডাউন ঘরটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর সেটি জনৈক আলী আকবর মিজি দোকান দেয়ার নামে রেল থেকে লীজপ্রাপ্ত হন এবং রেলওয়ে চা-স্টল নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। দীর্ঘ বছর যাবৎ সেখানে ব্যবসা করার পর সে দোকানটির নামকরণ করা হয় রেলওয়ে ক্যান্টিন। পরে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে লীজটি হস্তান্তর করেন চাঁদপুর শহরের কোড়ালিয়া এলাকার বাসিন্দা তাফাজ্জল হোসেন তপু বেপারীর ছেলে মোঃ জুলহাস বেপারীর কাছে। জুলহাস বেপারী ও আব্দুল কুদ্দুছ বেপারীর মধ্যে বন্ধুত্বের কারণে তারা এক যৌথ অংশীদারনামায় ব্যবসা করার জন্য একমত হন। সে মতে ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে অংশীদারনামা দলিল সৃষ্টি করেন। সে স্ট্যাম্প মূলে আব্দুল কুদ্দুছ বেপারী মোঃ জুলহাস বেপারীকে ৫০ হাজার টাকা জামানত বাবদ দেয় ও প্রতিমাসে ২শ’ টাকা করে ভাড়া দেয়ার অঙ্গীকার করে। সেখানে (জিএল-৪/সিআরটি/২৪৮/৮৯ স্মারক নম্বরে লীজপ্রাপ্ত) চাঁদপুর হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট নামে জুলহাস বেপারী ও আব্দুল কুদ্দুছ বেপারী যৌথ ব্যবসা পরিচালনা করার মনস্থ করেন। এ ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে যে মূলধন প্রয়োজন হবে তা সম্পূর্ণ দ্বিতীয় পক্ষ বিনিয়োগ করে ব্যবসা নিজ দায়িত্বে পরিচালনা করবে বলে স্ট্যাম্পে লিখিত হয়। আরো লেখা হয়েছে, প্রথম পক্ষের কোনো মূলধন বা দায়-দায়িত্ব থাকবে না। মুনাফা বাবদ মাসিক ২শ’ টাকার অধিক দাবি করতে পারবে না। সেখানে বলা হয়, খোদা না করুক কোনো প্রকার লোকসান হলে তজ্জন্য প্রথম পক্ষ দায়ী থাকবে না। এ চুক্তির মেয়াদ ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি হতে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরের জন্যে ছিলো। স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিতে বলা হয়, জামানতের টাকা প্রথম পক্ষের নিকট জামানত হিসেবে থাকবে। মেয়াদ শেষে দ্বিতীয় পক্ষ প্রথম পক্ষকে দখল বুঝিয়ে দিলে দ্বিতীয় পক্ষ জামানতের টাকা প্রথম পক্ষকে এককালীন বুঝিয়ে দিবে। এর মধ্যে রেলওয়ের ভাড়া, পৌর কর প্রথম পক্ষের দায়িত্বে থাকবে না।
মোঃ জুলহাস বেপারী ও আব্দুল কুদ্দুছ বেপারীর মধ্যকার যৌথ অংশীদারনামা ব্যবসার মেয়াদ ১ জানুয়ারি ১৯৯৫ সালে শেষ হয়ে গেলেও একমাত্র বিশ^াসের উপর ভিত্তি করে কোনো প্রকার চুক্তিনামা ছাড়াই ব্যবসাটি পরিচালিত হয়ে আসছিল। এরই মধ্যে আব্দুল কুদ্দুছ বেপারীর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর মোঃ জুলহাস বেপারী ও আব্দুল কুদ্দুছ বেপারীর পরিবারের মধ্যে তৎকালীন জাতীয় পার্টির সভাপতি অ্যাডঃ মাহবুবুল হক পাটওয়ারী ও কতেক সালিসের মাধ্যমে সালিস হয়। কিন্তু যৌথ অংশীদারনামা ব্যবসার অংশীদার বাদ দেয়া ছাড়াও মোঃ জুলহাস বেপারীকে তার মালিকানা থেকে বাদ দিয়ে তাকে ভাড়াটিয়া বানিয়ে মরহুম আব্দুল কুদ্দুছ বেপারীর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম একটি ভাড়াটিয়া চুক্তিনামা ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সৃজন করেন। তাতে বলা হয়, রেলওয়ের সে ভূমিতে ১ম পক্ষ (মনোয়ারা) মূলধনের অভাবে ২য় পক্ষের (জুলহাস বেপারীর) সাথে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে ব্যবসা করবে। আরো বলা হয়, ১ম পক্ষের দোকানঘর আর ২য় পক্ষের মূলধনে ব্যবসা পরিচালিত হবে। ২য় পক্ষ প্রতিমাসে ১ম পক্ষকে লাভ হিসেবে ১ হাজার টাকা দিবে। ২য় পক্ষ সিকিউরিটি বাবদ ১ম পক্ষের নিকট ৫০ হাজার টাকা গচ্ছিত রাখবে এবং মেয়াদ শেষে ১ম পক্ষ ২য় পক্ষের জামানতের টাকা বুঝিয়ে দিবে। এ ছাড়া ব্যবসা চলাকালীন বিদ্যুৎ, পৌরকর ও রেলওয়ের খাজনা ২য় পক্ষ পরিশোধ করবে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪ বছর মেয়াদে এই যৌথ কারবার বলবৎ থাকবে। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনরায় চুক্তিনামা নবায়ন না করে যারা দীর্ঘ ২০ থেকে ২২টি বছর ভোগদখলে থেকে সরকারকে যথাযথ নিয়মে ট্যাক্স দিয়ে যাচ্ছিলো তাদের সাথে পরামর্শ না করে অসদুদ্দেশ্যে পেশীশক্তি ব্যবহার করে মারাত্মক অনিয়ম করে। এই অনিয়মে মনোয়ারা বেগমের ছেলে জাকির হোসেন বেপারী গং রেলওয়ের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ৬ ব্যক্তির নিকট রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। যাদের কাছে রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রি করে এবং তাদের নিকট থেকে কতো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার একটি তালিকা তুলে ধরা হলো : মোঃ হুমায়ুন কবির খানের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা, মোবারক হোসেন শিকদারের কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা, কামাল হোসেন পাটওয়ারীর কাছ থেকে ২৭ লাখ টাকা, শ্রী মরণ চন্দ্র শীলের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা, মোঃ আবুল হোসেনের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা ও মানিক মিয়ার কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা। অভিজ্ঞ মহলের মতে, রেলওয়ের নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধা না করে যে লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি অবৈধভাবে কয়েক কোটি টাকায় বিক্রি করেছে সে বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেলওয়ের সম্পত্তি ফিরিয়ে আনা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রেতা মনোয়ারা বেগমের ছেলে জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ৩ কোটি টাকার রেল সম্পদ বিক্রি করেছি বৈধভাবে, তাতে কার কী। সরকারি নিয়মে লিজ নিয়ে বিক্রি করেছি। ‘রেলওয়ের নিয়ম রয়েছে, রেলওয়ের সম্পত্তি ভোগদখল করতে না পারলে রেলকে পুনরায় বুঝিয়ে দেয়া। আপনি বিক্রি করলেন কোন্ আইনে’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিক্রি করতে পারি বলেই বিক্রি করেছি। সেটা আমি রেল কর্তৃপক্ষের সাথে বুঝবো।

 

 

সর্বাধিক পঠিত