চাঁদপুরে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উদযাপন
সুশাসন নিশ্চিতের জন্যে তথ্য অধিকার আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ : জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান


জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), চাঁদপুরের সহযোগিতায় এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস-২০১৯ উপলক্ষে গতকাল ২৯ সেপ্টেম্বর রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণ থেকে র্যালি ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে র্যালি পরবর্তী আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান। সভায় সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ জামাল হোসেন। এবারের আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘তথ্যের অধিকার, সুশাসনের হাতিয়ার; তথ্যই শক্তি, দুর্নীতি থেকে মুক্তি’।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, সুশাসন নিশ্চিতের জন্যে তথ্য অধিকার আইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকল ধরনের অধিকারের ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি আরও বলেন, তথ্য অধিকার আইন সকল আইনের চেয়ে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের সমস্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে এমনকি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে তথ্যের দুয়ার উন্মুক্ত। যার ফলে মানুষের মাঝে তথ্য আইন ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের জন্যে জাতির পিতার স্বপ্ন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে পরিকল্পনা তা চাঁদপুর জেলায় শতভাগ সফল হবে। আর এজন্যে চাঁদপুরের সকল নাগরিকের সহযোগিতা একান্তভাবে প্রত্যাশা করছি। আসুন, আমরা তথ্য আইন ব্যবহারের মাধ্যমে এমনকি নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের তথ্যকে উন্মুক্ত করার মাধ্যমে একটি সুন্দর সোনার বাংলা গড়ে তুলি। তিনি তথ্য অধিকার আইনের সঠিক বাস্তবায়নের জন্যে তথ্যদাতা ও তথ্যগ্রহীতা উভয়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আজকের তথ্য অধিকার দিবসে অংশগ্রহণের জন্যে সকলকে ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। তথ্য অধিকার আইন আমাদের কাছে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক। তিনি বলেন, জনগণ সবচেয়ে বেশি তথ্য চাইতে আসে আমাদের কাছে। আর আমরা খুবই স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণকে তথ্য প্রদান করে থাকি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সুশাসনের দিক দিয়ে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। তথ্য পাওয়ার জন্যে আমাদের কাছে অনেক আবেদন জমা পড়ে। আমরাও সেগুলোর জবাব দিয়ে থাকি। এমনকি জনসাধারণের চাহিদা মোতাবেক সেবা প্রদান করে থাকি। তিনি আরও বলেন, সনাক-টিআইবি তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন ও এর সুবিধা জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে জেলা প্রশাসনের সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে তথ্যমেলা, তথ্য অধিকার দিবস, তথ্য অধিকার সপ্তাহ আয়োজনসহ চাঁদপুরে বহুবিধ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। আজকের অনুষ্ঠানটি আয়োজনেও সনাক-টিআইবি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছে।
সহকারী কমিশনার আবিদা সিফাতের সঞ্চালনায় সনাক সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ মোশারেফ হোসেন বলেন, পূর্বে তথ্য চাইতে গেলে মানুষ খুবই বিব্রতবোধ করতো। তথ্য অধিকার আইন পাস হওয়ার পর জনসাধারণ এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য চাইতে আসে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ সুশাসন নিশ্চিত করে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, আমরা তথ্য অধিকার আইনের এক দশক পূর্ণ করলাম। তবে জনগণকে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারে আরো উৎসাহিত করতে হবে। তিনি তথ্য অধিকার আইনকে কার্যকর করার জন্যে টিআইবি’র দাবিগুলো তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- তথ্য অধিকার আইনের আত্ততায় ব্যবসা, রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তথ্য অধিকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে; যেমন ব্যতিক্রম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ক্ষেত্রসমূহে জনস্বার্থের প্রাধান্যের বিষয়টি বিবেচনার রাখতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে; তথ্য ফরম পূরণের আবশ্যকতা হিসেবে তথ্য কর্মকর্তার নাম উল্লেখকরণ অপসারণ করতে হবে; সুুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় তথ্য অধিকার আইনে অনুরোধকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের বিবরণ প্রদানের বাধ্যবাধকতা বাদ দিয়ে অনুরোধকারী ব্যক্তি প্রদত্ত নির্দিষ্ট যে-কোন ঠিকানায় তথ্য প্রদানের সুযোগ রাখতে হবে; তথ্য অধিকার আইনে তথ্য প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিধান করতে হবে; তথ্য অধিকার আইনের পরিপন্থি’ বিদ্যমান আইনসমূহ সংস্কার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাতিল করতে হবে, যেমনÑ জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ৩২ ধারাসহ বাক্স্বাধীনতার পরিপন্থি অন্যান্য ধারা বাতিল করতে হবে; কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য প্রাপ্তির সঠিক আবেদন তৈরিতে সহায়তার জন্যে জনসাধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ‘তথ্য ও পরামর্শ ডেস্ক’ স্থাপন ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনলাইন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে; সকল কর্তৃপক্ষকে তথ্য অধিকার আইনের ধারা ৫ ও সংশ্লিষ্ট প্রবিধানমালা, ২০১০ অনুযায়ী তথ্য সংরক্ষণ এবং স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশের নীতিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে হবে; তথ্য অধিকার আইনকে অধিকতর সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে তথ্য কমিশনের উদ্যোগে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত আপিলসমূহ বিশ্লেষণ করা। সংশ্লিষ্ট অংশীজনকে সম্পৃক্ত করে পরবর্তী দশকের জন্যে বাস্তবায়ন কৌশল এবং আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে; দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও তথ্য প্রদানে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অর্জনে বিভিন্ন কারিগরি ও অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে; তথ্য-প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহার ও আইন বাস্তবায়নের গতি, তথ্য প্রদানে কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও সংগতি পর্যবেক্ষণে তথ্য কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ প্রেক্ষিতে তথ্য কমিশনের কার্যক্রমের গতিশীলতা ও কার্যকরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সম্পৃক্ততায় কমিশনের স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এর বাস্তবায়নে বার্ষিক জাতীয় বাজেটে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিতের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তথ্য অধিকার আইনের অধিকতর বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণমূলক কার্যক্রমে সুশীল সমাজ, জনগণ ও গণমাধ্যমের কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জাহেদ পারভেজ চৌধুরী বলেন, চাঁদপুর জেলা পুলিশের কাছে জনগণ তথ্য চেয়ে কোনো আবেদন করে না। তবে আপনারা পুলিশ সম্পর্কে যেকোনো তথ্য চাইতে পারেন। আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তথ্য প্রদান করবো। তিনি আরও বলেন, তথ্য অধিকার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। তবে এই আইনটিকে আরও বেশি কার্যকর করতে হবে আমাদেরকেই। আরো বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মণ চন্দ্র সূত্রধর।
পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন-এর মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইনের উপর আলোকপাত করেন টিআইবির এরিয়া ম্যানেজার মোঃ মাসুদ রানা। এরপর আলোচনা সভায় ‘তথ্য আবেদন ফরম’ পূরণ বিষয়ক দশ মিনিটের একটি বিশেষ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই সেশনে উপস্থিত সবার মধ্যে তথ্য আবেদন ফরম (ফরম-ক) সরবরাহ করা হয়। উপস্থিত অনেকেই আবেদন ফরম পূরণ করেন এবং সনাকের মাধ্যমে আবেদন ফরমগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে জমা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
উন্মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জেলা তথ্য অফিসার মোঃ নূরুল হক, জেলা মার্কেটিং অফিসার এমএন রেজাউল ইসলাম, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ সামসুজ্জামান, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ কবির হোসেন, ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ ফরিদ আহমেদ প্রমুখ। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীবৃন্দ, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, সনাক, স্বজন, ইয়েস ও ইয়েস ফ্রেন্ডস্ গ্রুপের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।