আকস্মিক মৃত্যুর শিকার ডাঃ রুহুল আমিন ॥ লৌহজংয়ে দাফন সম্পন্ন
যে কোনো ভালো কাজে সবার আগে তাঁকে পেয়েছি : শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি


চাঁদপুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক ও সমাজসেবক, বিএমএ চাঁদপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি, জেলা কমিউনিটি পুলিশিং সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি, চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ডাঃ একিউ রুহুল আমিন আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তিনি শুক্রবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় ঢাকাস্থ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে ইন্তেকাল করেন (ইন্না...রাজিউন)। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মরহুমের প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার পূর্বে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি বলেন, আমি তাঁকে যতটুকু চিনি, তাঁকে কোনো ভালো কাজে বলতে হয়নি। তিনি নিজ থেকে সকল ভালো কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতেন। চাঁদপুরের জনগণের জন্যে সমাজসেবামূলক অনেক ভালো কাজে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। আমি তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। তাঁর শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
জানাজার পূর্বে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল, চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আলহাজ জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, চাঁদপুর জেলা বিএমএ’র সভাপতি ডাঃ এমএন হুদা প্রমুখ।
জানাজায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোঃ মিজানুর রহমান, জেলা কমিউনিটি পুলিশিং সমন্বয় কমিটির সভাপতি ডাঃ এসএম সহিদ উল্লাহ, সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী শাহাদাত, সাধারণ সম্পাদক সুফী খায়রুল আলম খোকন প্রমুখ। পরে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার কাজীপাগলা গ্রামে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এবং বাদ আসর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে শ^শুর-শাশুড়ির কবরের পাশে দাফন করা হয়।
ডাঃ মোঃ এ. কিউ. রুহুল আমিনের জীবন বৃত্তান্ত
ডাঃ মোঃ এ. কিউ. রুহুল আমিন ১৯৫৩ সালের ১৫ অক্টোবর চাঁদপুর বড় স্টেশন রেলওয়ে কলোনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোঃ ইউনুছ মিঞা (বর্তমানে মরহুম) ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সিনিয়র ট্রাভেলিং টিকেট এক্সামিনার (টিটিই)। আর মাতা মোসাম্মৎ কাজী রিজিয়া বেগম (বর্তমানে মরহুমা) ছিলেন সুগৃহিণী। ডাঃ রুহুল আমিনের জন্ম চাঁদপুরে হলেও তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিলো কুমিল্লার সুয়াগঞ্জ এলাকার ঢুলিপাড়া গ্রামে। তিনি ৪ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড়। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে আক্কাছ আলী রেলওয়ে একাডেমীতে। তারপর গণি মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং এই বিদ্যালয়ে থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেন।
চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭১ সালে আইএসসি পাসের পর তিনি বরিশাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে এমবিবিএস পাসের পর কচুয়ায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে সরকারি চাকুরি পেলেও তা বাদ দিয়ে চাঁদপুর শহরের কালী বাড়ির পূর্ব পাশে পৌর নিউ মার্কেটে জেনারেল প্র্যাকটিশনার হিসেবে চিকিৎসা পেশায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তাঁর চেম্বারের পাশাপাশি অবস্থান নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা ফার্মেসী। তাঁর পিতা রেলওয়ের চাকুরি থেকে অবসরগ্রহণের পর এ ফার্মেসীতে বসতেন এবং চাঁদপুরেই মৃত্যুবরণ করেন। এ ফার্মেসী পরিচালনা করেন তাঁর অন্যতম ছোট ভাই নূরুল আমিন স্বপন।
ডাঃ রুহুল আমিন যখন চাঁদপুরে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হন, তখন চাঁদপুরে ডাঃ নূরুর রহমান (নূরু এমবি), ডাঃ এম.এ.গফুর (গফুর এমবি) ও ডাঃ আমিন আহমেদ (আমিন এমবি)-এর খ্যাতি ও যশ ছিলো ব্যাপক। এঁদের সমান্তরালে স্বল্প সময়ে ডাঃ রুহুল আমিন রোগীদের মাঝে এতোটা পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন যে, প্রতিদিন তাঁর সাক্ষাতের জন্যে দীর্ঘ সিরিয়াল পড়তো। আর কুমিল্লা ফার্মেসী ঔষধ ব্যবসায় এতোটা বিশ^স্ততা ও সুনাম অর্জন করে যে, ক্রেতাদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ঔষধ কিনতে হতো।
ডাঃ রুহুল আমিন নিজের অর্জিত অর্থে চাঁদপুর শহরের নাজিরপাড়ায় জায়গা কিনে ‘রাণী মহল’ নামে বাসভবন গড়ে তোলেন এবং রেল কলোনীর কোয়ার্টার ছেড়ে এখানেই সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। নব্বইর দশকের শেষ দিকে তিনি ঢাকার মগবাজারে ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রী-সন্তানদের স্থানান্তর করলেও চাঁদপুরে তাঁর প্র্যাকটিস অব্যাহত রাখেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নির্মিত নূতন বাসায় চলে যান এবং পরিবারের সদস্যদের চাপে তাদেরকে সময় দেয়ার প্রয়োজনে চাঁদপুরে তাঁর প্র্যাকটিসে অনিয়মিত হন। গত ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ছিলো তাঁর চেম্বারে তাঁর জীবনের শেষ কর্মদিবস। তিনি ওইদিন বিকেলে সড়কযোগে তাঁর ঢাকার বাসায় ফিরেন এবং পরদিন শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯) রাত সোয়া ১২টায় আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নেয়ার পথে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে ডাঃ রুহুল আমিন তাঁর স্ত্রী সালমা আমিন, ৩ মেয়ে (নদী, নিদ্রা ও নিশা) ও ১ ছেলে (আয়মান আমিন নবীন), নাতি-নাতনি সহ বহু আত্মীয় স্বজন ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। তাঁর দু মেয়েই ডাক্তার এবং ছোট মেয়ে বিবিএ পাস করার পর স্বামীর সাথে জার্মানীতে যান এবং সেখানেই বসবাস করছেন। ছেলে কম্পিউটার সায়েন্সে এআইইউবিতে অনার্স পড়ছে।
ডাঃ রুহুল আমিন চিকিৎসা পেশার পাশাপাশি চাঁদপুরে বহুবিধ সমাজসেবায় সংশ্লিষ্ট হন ও সাংগঠনিক দক্ষতায় বিভিন্ন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি সারাদেশে মডেল হিসেবে স্বীকৃত কমিউনিটি পুলিশিং চাঁদপুর অঞ্চল-১-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তীতে তিনি জেলা কমিউনিটি পুলিশিং সমন্বয় কমিটির সভাপতি পদে দুবার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চাঁদপুর শাখার সভাপতি এবং চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের সেক্রেটারী (১৯৮৪-৮৫) ও সভাপতি (১৯৮৭-৮৮) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সভাপতি থাকাকালীন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চাঁদপুর শহরের কবি নজরুল সড়কে চাঁদপুর রোটারী ক্লাবের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে চাঁদপুর রোটারী ভবন নির্মাণ করেন। তিনি চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, মাজহারুল হক বিএনএসবি চক্ষু হাসপাতাল, পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজ, উদয়ন শিশু বিদ্যালয়, টিআইবির সনাক, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির কার্যকরী/পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ডাঃ রুহুল আমিন সস্ত্রীক পবিত্র হজব্রত পালন করেন এবং ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি চাঁদপুর সেন্ট্রাল হস্পিটাল (প্রাঃ)-এর পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সদালাপী, মিশুক এই চিকিৎসকের আকস্মিক মৃত্যুতে চাঁদপুর শহরে শোকের ছায়া নেমে আসে।