ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও এবং জনমনের প্রশ্ন
ফরিদগঞ্জকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করবে কে?


ফরিদগঞ্জে মাদকের ভয়াবহ চিত্র দেখে এ উপজেলার আপামর জনসাধারণ উদ্বিগ্ন, চিন্তিত এবং শঙ্কিত। প্রায়ই এ উপজেলা থেকে মাদক উদ্ধার এবং আটক হচ্ছে। তাতে মাদকের ব্যাপক প্রসারতার চিত্র ফুটে উঠছে। তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অভিভাবকরা। বিশেষ করে গত ক’দিন যাবত সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া ইয়াবা নামক এক ভয়ঙ্কর মরণনেশা সেবনের চিত্রের ভিডিও দেখে শুধু চাঁদপুর বা ফরিদগঞ্জবাসীই নয়, দেশের সচেতন মানুষ হতবাক, স্তম্ভিত। কারণ, ওই মাদক সেবনকারীর পরিচয় দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ কমিটির নেতা। অথচ এ ভিডিও চিত্রটি ভাইরাল হওয়ার পর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, এই খাজা আহমেদ মজুমদার নামে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে কেউ নেই। কিন্তু সে নিজেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ-কমিটির সদস্য বলে গত কয়েক বছর যাবত প্রচার করে আসছে। এখানেই শেষ নয়, ফরিদগঞ্জের বর্তমান এমপির সাথে প্রায় সকল অনুষ্ঠানে তাকে প্রথম সারিতে দেখা যাওয়ায় মানুষজন আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় পদপদবীধারী এবং স্থানীয় এমপির সফরসঙ্গী হওয়ার সুবাদে ফরিদগঞ্জের প্রশাসন তাকে অনেকটা সমীহ করতো এবং সেও প্রশাসনের উপর সে প্রভাব খাটাতো। কিন্তু এর আড়ালে যে সে পুরো ফরিদগঞ্জকে ধ্বংস করে যাচ্ছিল তা অনেকে অনুভব করতে পারলেও তথ্য প্রমাণের অভাবে কেউ এতোদিন মুখ খুলে বলতে সাহস পাচ্ছিল না। কিন্তু গত কদিন এই খাজা আহমেদ মজুমদারের ১৮ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ইয়াবা সেবনের আসরের ভিডিও চিত্র সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর এবং গতকাল ওই ভাইরাল হওয়ার সংবাদটি স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে।
গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠের তৃতীয় পৃষ্ঠায় খাজা আহমেদ মজুমদারের ইয়াবা সেবনের ভিডিও চিত্রটি ভাইরাল হওয়ার সংবাদটি প্রকাশিত হয়। এরপর গতকাল সারাদিন ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন মহল থেকে পত্রিকা অফিসে অনেক ফোন আসতে থাকে প্রকাশিত ওই বিষয়টি এবং ফরিদগঞ্জের মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে। অনেক সচেতন মানুষ অঞ্চল ভিত্তিক মাদক বিক্রেতাদের নাম ঠিকানাও পত্রিকা অফিসে জমা দেন। তবে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হওয়ার বিষয় হচ্ছে, এসব মাদক বিক্রেতার সাথে মাঠ পর্যায়ে তথা ইউনিয়নভিত্তিক দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া পুলিশের সাথে দারুণ সখ্যতার বিষয়টি। জানা গেছে, ফরিদগঞ্জে ইউনিয়নভিত্তিক এসআই, এএসআইদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখার জন্যে। কিন্তু এসব পুলিশ অফিসার মাদক ব্যবসায়ীদের থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিয়ে তাদেরকে সে সুযোগ দিয়ে থাকেন বলে ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রকিব জানান, অভিযোগটি মোটেই সত্য নয়। এটি মাদক বিক্রেতাদেরই অপপ্রচার পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যে। এমন যদি হতো তাহলে মাদকের বিরুদ্ধে এতো মামলা হতো না। প্রায় প্রতিদিন ফরিদগঞ্জ থানায় মাদকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, আটক হচ্ছে, উদ্ধার হচ্ছে। তারপরও তিনি এ বিষয়ে সজাগ থাকবেন বলে জানান।
সার্বিক তথ্য সূত্রে জানা গেলো, ফরিদগঞ্জের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ইয়াবা এখন সবচেয়ে সহজলভ্য মাদক। এই ইয়াবার ডিলার এবং এর নিয়ন্ত্রক খাজা আহমেদদের মতো কয়েকজনের হাতে থাকলেও এর খুচরা বিক্রেতা হবে শতাধিক। এরাই উপজেলার সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইয়াবা বিক্রি করে থাকে। আর ফরিদগঞ্জে যে ইয়াবা সয়লাবের চিত্র খুবই ভয়াবহ, তা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ আটক হওয়া এবং উদ্ধার হওয়ার চিত্র দেখলেই অনেকটা অনুমান করা যায়। কিছুদিন আগে ফরিদগঞ্জ থেকে মোটরসাইকেলসহ কয়েক হাজার ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা তাই বলে দেয়।
ফরিদগঞ্জে যারা সুস্থ ধারার রাজনীতি করেন, তাদের অনেকেই জানান, শুধু এক খাজাই নয়, এমন আরো অনেক খাজা রয়েছে, যারা রাজনৈতিক দলের পদপদবী ব্যবহার করে এই মাদক ব্যবসা করছে। তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের সাথে সরাসরি জড়িত। আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদেও তারা রয়েছে। এ জন্যে হয়ত পুলিশ সাহস পাচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশানে যেতে। তবে ফরিদগঞ্জকে বাঁচানোর স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স শুধু কথায় নয়, বাস্তবে কার্যকর করতে এ বিষয়ে অন্ধ হয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন ফরিদগঞ্জবাসী।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল বলেন, মাদকের ব্যাপারে কোনো আপস নেই, এবার সে যেই হোক। জননেত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এ বিষয়ে রয়েছে আমাদের জিরো টলারেন্স। দলের পদ-পদবীধারী কেউ যদি মাদক সেবন বা বেচা-কেনার সাথে জড়িত থাকে, আমি প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ করবো আপনারা নির্ভয়ে তাদের আইনের আওতায় আনুন। প্রশাসন কেনো মাদকের ব্যাপারে দলীয় পরিচয় খুঁজতে যায়? প্রশাসনের দায়িত্ব যা তা সঠিকভাবে পালন করবে বলে আমার বিশ^াস এবং প্রত্যাশা।
এদিকে ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব থেকে গত মাসের উপজেলা সমন্বয় সভায় যে দাবি করা হয়েছিলো তা বাস্তবায়ন করা হলে ফরিদগঞ্জকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করা যাবে বলে মনে করেন সচেতন মহল। দাবিটি ছিলো, পুরো উপজেলায় যারা মাদক বিক্রেতা আছে তাদেরকে একটি সময়ের আল্টিমেটাম দিয়ে দেয়া যে, এতোদিনের মধ্যে তারা থানা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা করা হবে। আর যদি ওই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করে তাহলে তাদেরকে অভিযানে আটক করা এবং পাশাপাশি এদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করার জন্যে এদের ছবিসহ বড় বড় বিলবোর্ড বানিয়ে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এবং দর্শনীয় স্থানে লাগিয়ে দেয়া। আর এ পুরো বিষয়টি প্রশাসনের উদ্যোগে পুরো উপজেলায় মাইকিং করবে যাতে মাদকের গডফাদাররা সামাজিক মান সম্মানের ভয়ে হলেও আত্মসমর্পণ করে সেই পথ থেকে ফিরে আসে।