• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

লঞ্চ মালিক পক্ষের উদাসীনতা

চাঁদপুর-ঢাকা নৌরূটে হাজার হাজার যাত্রীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই ॥ অপরাধ ও দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে

প্রকাশ:  ১৯ জুলাই ২০১৯, ১৬:৩৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুর-ঢাকা নৌরূটে ভ্রমণ আরামদায়ক হওয়ার কারণে যাত্রীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেজন্যে এ রূটে ২৪টি লঞ্চ নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে। এসব লঞ্চে প্রতিদিন চাঁদপুর ছাড়াও নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও শরীয়তপুর জেলার হাজার হাজার যাত্রী ভ্রমণ করলেও তাদের নিরাপত্তার জন্যে কোনো লঞ্চেই গত সাড়ে ৩ বছর যাবৎ অস্ত্রধারী আনসার নেই। যার ফলে লঞ্চগুলোতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। অপরাধীরা সুযোগ নিয়ে সহজ-সরল অনেক যাত্রীকে বিভিন্ন প্রতারণা ও নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে খাবার খাইয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে যাচ্ছে। একসময় লঞ্চগুলোতে আনসার সদস্য থাকলেও সরকারি নিয়মানুসারে বেতন বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদেরকে চাকুরি থেকে বিদায় করে দেয় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে বার বার তাগিদ দিলেও এখন পর্যন্ত সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা-চাঁদপুর নৌ-রূটে বর্তমানে বিলাসবহুল বৃহত্তর আকারের লঞ্চ চলাচল করছে। এসব তিনতলা লঞ্চ নির্মাণে ব্যয় হয় আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ এ রূটে পূর্বে দুই তলাবিশিষ্ট ছোট একটি লঞ্চ দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও অনেকে এখন একাধিক বৃহত্তর আকারের লঞ্চের মালিক। তাদের ব্যবসা যে লাভজনক হচ্ছে সেটি বুঝার বাকি নেই। লঞ্চগুলোতে সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত করা হলেও নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। অথচ এ রূটের যাত্রীরা সৌখিন হওয়ার কারণে মাত্র ৩ ঘণ্টার জন্যে প্রথম শ্রেণিতে ২৫০ টাকা থেকে শুরু করে কেবিনগুলোতে ৫শ’ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছেন।
চাঁদপুর লঞ্চঘাটে কর্মরত বিভিন্ন লঞ্চের মালিক প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদপুর লঞ্চঘাট, চরভৈরবী, নীলকমল ও ঈদগাহ ফেরিঘাট থেকে প্রতিদিন ২৪টি লঞ্চ যাতায়াত করে। এছাড়া ঢাকা  ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী আরো প্রায় ২৫টি লঞ্চ ভায়া হয়ে চাঁদপুর ঘাটে ভিড়ে। চট্টগ্রাম থেকে আগত যাত্রীদের বেশির ভাগ দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলো দিয়ে তাদের গন্তব্যে যায়। চাঁদপুর রূটের লঞ্চগুলোর পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলোতেও নিরাপত্তার জন্যে কোনো অস্ত্রধারী বাহিনী নেই। যার ফলে অঘটন ঘটে চলেছে। গত রোববার (১৪ জুলাই) ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ভা-ারিয়াগামী এমভি টিপু-১২ লঞ্চে মলমপার্টির সদস্যরা দুই যাত্রীকে খাবারের সাথে নেশাজাতীয় দ্রব্য মিশিয়ে এবং শরীরে মলম মেখে দিয়ে গুরুতর অসুস্থ করে। এ সময় ওই মলমপার্টির সদস্যরা তাদের মালামাল লুটে নেয়। এ ঘটনায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ, লঞ্চ মালিক প্রতিনিধি ও চাঁদপুর নৌ-পুলিশের সহযোগিতায় মলমপার্টির দুই সদস্যকে আটক করা হয় ও অসুস্থদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দেয়া হয়। পুলিশ এ ঘটনায় মলমপার্টির দুই সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
এরপূর্বে গত ১৭ জুন চাঁদপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া এমভি মিতালী-৭ নামক লঞ্চ থেকে ঢাকার সদরঘাটে নিলুফা (২৭) নামে নারীর মরদেহ উদ্ধার করে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, এমভি মিতালী-৭-এর তিন তলার ৩০৯ নম্বর কেবিনের তালা বন্ধ দেখে থানায় খবর দেয় লঞ্চের লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় ওই নারীর মরদেহ উদ্ধার করে।  ধারণা করা হচ্ছে, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার পরনে ছিলো প্রিন্টের কামিজ ও বাটিকের সালোয়ার। ময়না তদন্তের জন্যে মরদেহ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
চাঁদপুর-ঢাকা ও দক্ষিণাঞ্চল রূটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো গত ক’বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহুবার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এছাড়া লঞ্চ থেকে যাত্রীদের ফেলে দেয়া, লঞ্চগুলোতে অসামাজিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়া, লঞ্চে যাত্রীদের হত্যা করে কেবিনে রেখে চলে যাওয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনার পরে খবর পেয়ে পুলিশ এবং উপজেলা প্রশাসন যাত্রীদের নিরাপত্তায় এগিয়ে এসেছে। এমন ঘটনা নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে বহুবার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা পুলিশের কাছে অভিযোগ আবার কেউ কেউ মামলাও দায়ের করেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে লঞ্চ থেকে ফেলে দেয়া বা পড়ে যাওয়া যাত্রীদের মৃত্যুর পরে নদীতে লাশ ভেসে উঠলে পরিচয় না পেয়ে অজ্ঞাত হিসেবেও দাফন করা হয়। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে তাৎক্ষণিক উদ্ধার ও প্রাথমিক নিরাপত্তার ন্যূনতম সুবিধার আওতায় থাকতেন যাত্রীরা।
এ বিষয়ে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে কর্মরত লঞ্চ মালিক প্রতিনিধিরা জানান, স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে নৌ-পথে নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে যাত্রীবাহী লঞ্চে অস্ত্রধারী আনসার দায়িত্ব পালন করতো। তখন অনেক আনসার ডাকাতিকালে ডাকাতদের প্রতিরোধ করে ডাকাতি বন্ধ ও ডাকাতদের আটক করতে সক্ষম হয়েছিলো। আবার কিছু আনসার সদস্য ডাকাতির সাথে জড়িত থাকার ঘটনাও ঘটে। বর্তমান সরকার কর্তৃক বেতন বৃদ্ধির ফলে আনসার সদস্যদের পূর্বে যে বেতন ছিলো ৮ হাজার ৭শ’ টাকা, বর্তমানে সেটি ১৩ হাজার ৫০ টাকা হওয়ায় লঞ্চ মালিকরা তাদের লঞ্চ থেকে আনসার সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেন।
চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছি। গত ঈদুল ফিতরের পূর্বেই ওই চিঠি দেয়া হয়। তাদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পুনরায় প্রয়োজনে চিঠি দিবো। লঞ্চ মালিকদেরকে একত্রিত করে আলোচনা করলে এই বিষয়ে হয়তো একটি সিদ্ধান্ত আসা যেতো। আগামী ২১ জুলাই চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের আয়োজনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা রয়েছে। ওই সভায় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হবে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর সদর উপজেলা আনসার ও ভিডিপি অফিসার (পরিদর্শক) মোঃ মজিবুর রহমান জানান, লঞ্চ মালিকরা তাদের লঞ্চে যাত্রীদের নিরাপত্তায় যদি আনসার চাহিদা প্রেরণ করেন, তাহলে জেলা এডজুটেন্ট অফিস থেকে আনসার দেয়া যেতে পারে। তারা সরকারের সাথে চুক্তি করে অগ্রিম টাকা দিলে আনসার পাবে। গত সাড়ে ৩ বছর পূর্বে লঞ্চ মালিকরা সরকারি বেতন বৃদ্ধি হওয়ার পর থেকে আনসার প্রত্যাহার করে নেয়।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, চাঁদপুর-ঢাকা নৌ-রূটের যাত্রীদের সমস্যা ও অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্যে জেলা প্রশাসন বিআইডাব্লিউটিএ’র মাধ্যমে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করেছেন। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যে বারবার লঞ্চে নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। যেহেতু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ দেননি, আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষে এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির বিপিএম, পিপিএম বলেন, নৌ-পথের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে নৌ-পুলিশ। লঞ্চের যাত্রীদের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে বিষয়টি আমার সামনে আসার পর লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে আমি জানিয়েছি। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে প্রত্যেক লঞ্চের মালিককে বলা হবে। জেলা প্রশাসন ইতঃমধ্যে এ বিষয়ে লিখিত চিঠি দিয়েছে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে। আগামী আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এই বিষয়ে জেলা পুলিশের জোরালো ভূমিকা থাকবে।