• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

বিদ্যুৎ বিভাগের সীমাহীন দুর্নীতি আর অনিয়মের খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহক

প্রকাশ:  ২৭ জুন ২০১৯, ১৪:০০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন চাঁদপুর বিদ্যুৎ বিক্রয় ও বিতরণ কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালী কর্মকা-ের কারণে গ্রাহকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দিন দিন বেড়েই চলছে। বকেয়া কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল আদায়ের নামে চাঁদপুর পিডিবি কর্তৃপক্ষ বলতে গেলে গ্রাহকদের উপর স্টিম রোলার চালাচ্ছে। কি সরকারি অফিস, কি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কি বাসা-বাড়ি। কেহই রেহাই পাচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগের ওই ভূতুড়ে বিলের অত্যাচার থেকে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিল দেয়ার কোনো খবর নেই, অথচ এখন হঠাৎ একেকজন গ্রাহককে কয়েক লাখ টাকা বিলের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ১২ ঘণ্টা না যেতেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। এমনও দেখা গেছে যে, গ্রাহক এই বিল এবং মিটার সম্পর্কে জানেই না, অথচ তার নামে কয়েক লাখ টাকার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে, যার নামে ভূতুড়ে বিল দেয়া হয়েছে, তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে তার ছেলের বাসার বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এর জবাব জানতে চাইলে চাঁদপুর পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলীর অদ্ভূত ধরনের উত্তর হচ্ছে-মা’র বাসার বকেয়া বিলের দায়ে ছেলের বাসার বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এ জন্য যে, যেনো ছেলে বকেয়া পরিশোধে দৌড়ে বিদ্যুৎ অফিসে আসে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে-যে মিটারের নামে বকেয়া বিল দেয়া হয়েছে সে মিটারের ঠিকানা অনুযায়ী তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন। তাই ভূতুড়ে এ বিল আদায়ের জন্যে ওই মিটার গ্রাহকের ছেলের বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। অথচ ছেলে ও মার বাসার দূরত্ব হবে কমপক্ষে ২ কিলোমিটার। এখানেই শেষ নয়, একটি সরকারি অফিসের কয়েক মাসের ব্যবধানে ভূতুড়ে বিদ্যুৎ বিল দুইবার লক্ষাধিক টাকা পরিশোধ করার পরও পরের মাসেই আবার ৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা বকেয়া বিলের চিঠি দেয়া হয়।
এইসব ভূতুড়ে বিল, অস্তিত্বহীন মিটারের বিল এবং এক মিটারের বকেয়ার দায়ে অন্য মিটারের গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণ বিষয়ে চাঁদপুর পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম ইকবালের সাথে কথা হলে তিনি নানাভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিলেও একপর্যায়ে তিনি বলতে বাধ্য হন যে, ভেতরের এবং বাইরের একটি অসাধু চক্র অবশ্যই অতীতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলো। সেটি আমার অফিসের কোনো একটি অসাধু চক্রও থাকতে পারে। এখন বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে গিয়ে সে অনিয়মগুলো বের হয়ে আসছে।
বিদ্যুৎ সাশ্রয় এবং বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রোধ করার জন্যে সরকার প্রিপেইড মিটার চালু করে। চাঁদপুরে গত ২ বছর যাবৎ পূর্বের এনালগ মিটারের পরিবর্তে প্রিপেইড মিটার সংযোগ কার্যক্রম চালু হয়। এই মিটার লাগাতে গিয়ে অনেক জায়গায় বিদ্যুতের লোকজন বাধার সম্মুখীন হয়েছে, এমনকি হামলার শিকারও হয়েছেন। তারপরও সমাজের সচেতন মানুষের এবং রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে ও সহযোগিতায় প্রি-পেইড মিটার  লাগানোর কাজ চলতে থাকে। এ পর্যন্ত প্রায় ৯৯ ভাগ আবাসিক গ্রাহকের প্রিপেইড মিটার সংযোগ হয়ে গেছে। তথ্য মতেÑচাঁদপুর পিডিবির ৬০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৫২ হাজার হচ্ছে আবাসিক গ্রাহক। বাদবাকি ৮ হাজার গ্রাহক বাণিজ্যিক। জানা গেছে, ৫২ হাজার আবাসিক গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহকের প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন গ্রাহকের প্রিপেইড মিটার লাগানোর ৬ মাস কি এক বছর পার হওয়ার পর গত কয়েকমাস ধরে গ্রাহকদের কাছে তার পূর্বের এনালগ মিটারের বকেয়া বিল আসা শুরু হয়। একেক মিটারের বিপরীতে নীচে ৫০ হাজার উপরে ৪-৫ লাখ টাকা করে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কাগজ আসতে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছেÑবকেয়া বিলের কাগজ দেয়ার ১২ ঘন্টা পার না হতেই এই গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দেখা গেছে যে, কারো কারো এনালগ মিটারের সর্বশেষ বিল পর্যন্ত পরিশোধ করা আছে। এ ধরনের বিল পরিশোধের কাগজ নিয়ে যখন ওই ভুক্তভোগী গ্রাহক বিদ্যুৎ অফিসে এসেছে, তখন বলা হয় তাহলে ব্যাংক থেকে এই হিসাবটি বিদ্যুতের কুমিল্লা অফিসে পাঠানো হয়নি। চাঁদপুর বেগম জামে মসজিদের বেলায় এমন একটি ঘটনা ঘটে। অথচ গ্রাহকের এনালগ মিটারের পরিবর্তে যখন প্রিপেইড মিটার লাগানো হয়, তখনই তো ওই গ্রাহকের এনালগ মিটারের বিপরীতে কোনো বিল বকেয়া আছে কিনা তা দেখার কথা এবং থাকলে তা নির্দিষ্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে পরিশোধ সাপেক্ষে প্রিপেইড মিটার লাগানোর কথা। কিন্তু তা না করে প্রিপেইড মিটার ব্যবহারের ৬ মাস কি ১ বছর পর এসে ওই গ্রাহককে পূর্বের এনালগ মিটার বাবদ বিশাল অংকের ভূতুড়ে বিলের কাগজ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার অনেক গ্রাহক এমনও অভিযোগ করেছেন, তাদের প্রিপেইড মিটার লাগানোর সময়ই তারা এনালগ মিটারের সর্বশেষ বিল পরিশোধের কাগজ দেখিয়েছে। অর্থাৎ এক টাকাও তার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া নেই। তাহলে ছয় মাস পর আবার কোত্থেকে পূর্বের মিটারের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া আসে? এটি বিদ্যুৎ বিভাগের অসাধু লোকজনের চুরি এবং দুর্নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
জানা গেছে, চাঁদপুর শহরের প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ফারুক মৃধার মায়ের নামে (সাহানারা বেগম) চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডের ঠিকানায় একটি মিটার বাবদ ৪৮ হাজার ৫শ’ ৯৭ টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের কারণে ফারুক মৃধার চক্ষু হাসপাতাল এলাকার বাসার প্রিপেইড মিটার বন্ধ করে দেয়া হয়। ঘটনাটি ঘটে এ মাসের প্রথম দিকে। ফারুক মৃধার বাসার মিটারে যখন টাকা রিচার্জ করতে বিদ্যুৎ অফিসে তার লোক যান, তখন বলা হয় বকেয়া বিলের কারণে মিটারটি বন্ধ রয়েছে। তখনই ভূতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। ওই সময় ফারুক মৃধা ছিলেন ওমরা হজ পালনে সৌদি আরব। বকেয়া বিলের কাগজ যেদিন দেয়া হয় পরের দিনই  ফারুক মৃধার চক্ষু হাসপাতাল এলাকার নিজ বসতবাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রশ্ন হচ্ছে-বকেয়া যদি থেকেও থাকে, সেটি ফারুক মৃধার মা সাহানারা বেগমের নামে মিটারের বকেয়া। তার জন্যে সাহানারা বেগমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে তার ছেলে ফারুক মৃধার বাসার সংযোগ কেনো বিচ্ছিন্ন করা হলো? অথচ দুই বাসার দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এ সমস্যায় পড়ে ফারুক মৃধার অনুপস্থিতিতে তার আত্মীয় স্বজন বিষয়টি নিয়ে কয়েকজন সংবাদকর্মীর শরণাপন্ন হয়ে তাদের নিয়ে বিদ্যুৎ অফসে যান। তখন নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে ‘মার বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার জন্যে ছেলের বাসার সংযোগ কেনো বিচ্ছিন্ন করা হলো’ এর জবাব জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি এর জবাব দিলেন, ‘ছেলের বাসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় আজ আপনারা (ফারুক মৃধার আত্মীয় স্বজন) এসেছেন।’ তাঁর এমন হাস্যকর জবাবে সবাই হতবাক হন। বিষয়টি যেনো এমন ‘একজনের অপরাধে আরেকজন শাস্তি ভোগ করা।’ তারপরও ফারুক মৃধার স্বজনরা চ্যালেঞ্জ করেন যে, বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের ৪৮ হাজার ৫শ’ ৯৭ টাকা যে বিল দেয়া হয়েছে এ ধরনের কোনো মিটার সাহানারা বেগম ব্যবহার করেননি। তাঁর নামে যে মিটার ছিলো সে মিটারের সর্বশেষ পরিশোধকৃত বিলের কাগজ তখন তারা দেখান। তখন নির্বাহী প্রকৌশলী একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন এবং বললেন যে, তাহলে কীভাবে সাহানারা বেগমের নামে এ মিটারটি আসলো? পরক্ষণেই আবার তিনি বললেন, এমনও হতে পারে তার নামের মিটার হাইড করে অন্য কেহ এটি ব্যবহার করেছে। আর এ ক্ষেত্রে ভেতরের-বাইরের অর্থাৎ বিদ্যুৎ অফিসের এবং বাইরের অসাধু কোনো চক্র অবশ্যই জড়িত। এখন বকেয়া বিদ্যুৎ বিল আদায় প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়েছে তখনই ওইসব অনিয়ম বের হয়ে আসছে। ভুক্তভোগীদের কথা হচ্ছে-অসাধু চক্রের অনিয়মের এবং দুর্নীতির কারণে আমরা সাধারণ গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হবো কেনো।
এভাবে চাঁদপুর বিএডিসি সেচ প্রকল্প অফিসকেও ৭-৮ মাসের ব্যবধানে তিনবার তিন ধরনের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের চিঠি দেয় চাঁদপুর পিডিবি। প্রথমবার দেয়া হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকার বকেয়া বিল। সেটি তারা পরিশোধ করেন। পরে আবার ৮ মাসের ব্যবধানে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের দায়ে তাদের প্রিপেইড মিটার বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে চিঠি চালাচালির মাধ্যমে পূর্বের বকেয়া বিল পরিশোধের বিষয়টি জানানোর পরও তাদেরকে ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকা বকেয়া বিল দিতে হয়। এখানেই শেষ নয়, আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে-দুইবার বকেয়া পরিশোধের পর গত ১৬ জুন বিএডিসি কর্তৃপক্ষকে পুনরায় ৪ লাখ ১৭ হাজার ৬শ’ ৭৮ টাকা বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের চিঠি দেয়া হয়।
এ বিষয়গুলোকে ভুক্তভোগী জনগণ বিদ্যুৎ বিভাগের খামখেয়ালিপনা এবং অতীতের দুর্নীতির খেসারত হিসেবে দেখছেন। এর থেকে মুক্তি দিতে জনগণ স্থানীয় প্রশাসন এবং চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। জনগণ আরো বললেন, নিয়ম অনুযায়ী কারো এক মাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হলে পরের মাসেই তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিবে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন দূরে থাক, বিলের কাগজ কখনো পাঠানো হয়নি, অথচ হঠাৎ এক সময় লাখ লাখ টাকার বকেয়া বিল দেখিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে। এর ভেতরে অন্য কিছু লুকায়িত আছে, যা সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম তদন্ত শেষে হয়ত বেরিয়ে আসবে।

সর্বাধিক পঠিত