সচেতন অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন
সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলছে ॥ অভিভাবকদের উদাসীনতা ও আস্কারাই অনেকাংশে দায়ী
স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আপত্তিকর আড্ডায়


উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়ে তথা কিশোর-কিশোরীদের চলাফেরা, আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথাবার্তা, লিঙ্গভেদে পোশাকের তারতম্য, শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন অভিভাবক মহল গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে গভীর উদ্বেগের সাথে বলেন, আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কেমন যেনো নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে চলে যাচ্ছে। অপরিণত বয়সী তথা স্কুলের ছেলে-মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তাঘাটে বখে যাওয়া ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা চোখে পড়ছে বেশি। এতে করে সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বেড়ে চলছে। এতে সচেতন ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। তারা উদ্বেগের সাথে জানান, ছেলে-মেয়ে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাওয়া এবং বখে যাওয়ার পেছনে অভিভাবকরাই অনেকাংশে দায়ী। তাদের উদাসীনতা এবং আস্কারাতেই সন্তানরা বখাটে হয়ে যাচ্ছে। চাঁদপুর শহরে এমন সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বেড়ে চলতেই দেখা যাচ্ছে। সচেতন অভিভাবকরা বলছেন, একটি সভ্য সমাজ বিনির্মাণে একটি সভ্য ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটিকে যেনো সকল পর্যায়ের নেতৃস্থানীয়রা উদাসীন।
চাঁদপুর শহরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন স্পটে বিচরণ করলে অবিশ^াস্য রকমের দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখা যাচ্ছে যে, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা দিচ্ছে। আবার এ আড্ডা কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায় অশালীন। বখে যাওয়া এসব স্কুলের ছেলে-মেয়ে বাসা থেকে স্কুলব্যাগ ও স্কুলড্রেস পরে বের হয় ঠিকই, কিন্তু পথে এসে সে আর স্কুলে যায় না, চলে যায় আড্ডায়। বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চলে যায়। অনেক সময় শহরের বাইরে পার্কসহ বিনোদনের বিভিন্ন স্পটে চলে যায়। এছাড়া অনেক সময় দেখা যায় যে, শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ভেতরে লোকচক্ষুর কিছুটা অন্তরালে বসে ওই স্কুল ফাঁকি দেয়া ছেলে-মেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে। আবার কিছু কিছু ছেলেকে মাদকও সেবন করতে দেখা যায়।
দিনের বেলা স্কুল-কলেজের সময়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায় চাঁদপুর শহরের এমন বেশ ক’টি স্পটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রেসক্লাবের পেছনেসহ আশপাশ এলাকা, জেলা পরিষদ বাংলোর পেছনে নদীর পাড়ে ঝোপঝাড়, আল-আমিন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজ ভবনের পূর্ব পাশে পৌর উদ্যান, উদ্যান সংলগ্ন বোগদাদিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে নদীর পাড়ে ঝোপঝাড়, বড় স্টেশন মোলহেড এলাকা, আদালতপাড়ার ভেতরে মাদ্রাসার পেছনে পশ্চিম পাশে খালি জায়গায়, সিএনজি স্কুটার স্ট্যান্ড এলাকায়, আলিমপাড়ার ভেতরে রেললাইন এলাকা, লেডী দেহলভী স্কুলের পেছনে ও সামনে, মাতৃপীঠ ও হাসান আলী প্রাইমারী স্কুলের আশপাশসহ আরো কিছু এলাকা। এসব এলাকায় দিনের বেলা উঠতি বয়সী বখাটে তরুণ ও কিশোরদের আড্ডারত অবস্থায় দেখা যায়। এদের মধ্যে স্কুলপড়–য়া ছেলে-মেয়েও থাকে। এরা বাসা থেকে স্কুল ড্রেস পরে বের হয় ঠিকই, কিন্তু স্কুল ব্যাগের ভেতরে করে সাধারণ পোশাকও নিয়ে আসে। বাহিরে এসে সুবিধামত জায়গায় গিয়ে স্কুলড্রেস খুলে বাসার সাধারণ ড্রেস পরে। আবার কিছু কিছু মেয়ে বোরখা পরা অবস্থায় থাকে। এতে করে তাদের চেনাও যায় না। এসব স্পট ছাড়াও কিছু কিছু ছেলে-মেয়ে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুডের দোকান এমনকি হোটেলেও চলে যায়। পুরো স্কুলসময় তারা এসব জায়গায় সময় কাটিয়ে এরপর বাসায় যায়।
স্কুলের ছেলে-মেয়ে এবং বখাটে তরুণ, কিশোর ও যুবকদের বখাটেপনা এবং অসময়ে আড্ডা চাঁদপুর শহরে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এদের যদি কোনো সচেতন মানুষ ডাক দেয়, বারণ করে অথবা বাধা দেয় তাহলে উল্টো ওই মানুষগুলোকে বখাটেদের রোষানলে পড়তে হয়। তখন তারা নিজেদের ‘সাধু’ দেখানোর জন্যে সামাজিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত থাকার গল্প আঁটে। এমনও দেখা যায় যে, ১৫/১৬ বয়সের ওইসব বখাটে কিশোর চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী ওই প্রতিবাদকারীর উপর চড়াও হয় এবং তার সাথে চরম বেয়াদবী আচরণ করে। আর এই বেয়াদবী আচরণ সহ্য করতে না পেরে যখন ওই প্রতিবাদী সচেতন মানুষগুলোর কেউ বখাটেদের শাসন করতে যান, তখন দেখা যায় যে, তাদের অভিভাবকরা উল্টো তাদের সন্তানদের পক্ষ নিয়ে ওই প্রতিবাদকারী মানুষগুলোকে নানাভাবে নাজেহাল করে থাকে। আর তখনই সন্তানরা অভিভাবকদের থেকে আস্কারা পায়। এরপর আর তারা কোনো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এভাবেই সামাজিক অবস্থা অবক্ষয়ের দিকে যেতে থাকে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় সচেতন কিছু অভিভাবকের সাথে। তারা নির্দ্বিধায় বললেন, আসলে সন্তান বখে যাওয়ার পেছনে আমরা অভিভাবকরাই দায়ী। কারণ, আমরা নিজেদের নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে যাই যে, আমার সন্তান কোথায় যায়, কী করে, সময়মতো ক্লাসে গেলো কি না, ক্লাস শেষে সময়মতো বাসায় ফিরলো কি না, আবার স্কুলে গেলো ঠিক কিন্তু মিথ্যা কোনো কারণ দেখিয়ে স্কুল থেকে বের হয়ে গেলো কি না, কাদের সাথে বন্ধুত্ব করছে, আড্ডা দিচ্ছে এসব খোঁজ খবর রাখি না। আবার অতি আদরের নামে সন্তানের আবদার রাখতে গিয়ে এমন কিছু জিনিস তাদের দিয়ে দেয়া হয় যার দ্বারা সে খারাপ পথে চলে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তারা উল্লেখ করলেন ‘স্মার্ট ফোন’। স্কুলপড়–য়া ছেলে-মেয়েকে দামী স্মার্ট ফোন কিনে দেয়ার কোনো কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে না বলে তারা মনে করেন। এছাড়া সন্তানের চুলকাটা, নখ কাটা, রুচিশীল ও ভদ্রোচিত পোশাক পরা এসব বিষয়েও আমরা অভিভাবকরা সন্তানদের কোনো আদেশ, উপদেশ বা কাউন্সিলিং করি না। শুধু তাই নয়, অবস্থা এমন যেনো আমাদের ছেলেমেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল বন্ধু যতবেশি হতে পারে ততই এটা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমরা সন্তানদেরকে পারিবারিক শিক্ষা এখন আর দেই না। মুরুব্বিদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, শিক্ষকদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে এসব শিক্ষা আমরা সন্তানদের দেই না। উপরন্তু আমরা তাদের অন্যায় কাজে প্রশ্রয় দেই। তাই সামাজিক অবস্থা যা হবার তাই হচ্ছে। আর এসব অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, শাসন থাকতে হবে এবং সন্তানদের অতি আদরের নামে মাথায় তোলা যাবে না।