চাঁদপুর নৌ-টার্মিনালে ভাসমান ইলিশের হাট : প্রতিদিনই সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে
চাঁদপুর নৌ-টার্মিনাল এলাকায় প্রতিদিন মেঘনা নদীতে এক শ্রেণীর বেদে মাছ বিক্রেতা ভাসমান ইলিশের হাট বসিয়ে প্রতারণা করে অসাধু উপায়ে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। তারা দক্ষিণাঞ্চলীয় ও হাতিয়ার ইলিশকে পদ্মা-মেঘনার ইলিশ বলে বিক্রি করছে। তাদের কাছ থেকে চড়া দামে ইলিশ ক্রয় করে লঞ্চযাত্রীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে। তাজা ইলিশের সাথে পচা ইলিশ একত্র করে ক্রেতাদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে বেদে মাছ বিক্রেতারা। এসব মাছ বিক্রেতা ছাড়া অন্য কোনো মাছ ব্যবসায়ীরা মাছ বিক্রি করে না বলে লঞ্চঘাটের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষেরা জানান। এদের সাথে কেউ প্রতিবাদ করলে ক্রেতাদের সাথে খারাপ আচরণ করে থাকে। এ ব্যাপারে স্থানীয় নৌ-টার্মিনালের দায়িত্বে থাকা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ-পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। প্রতিদিন শত শত লঞ্চযাত্রী ইলিশ মাছ কিনে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেতে চায়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর নৌ-টামিনাল এলাকায় যাত্রীবাহী লঞ্চের পাশে মেঘনা নদীতে ভাসমান ইলিশের হাট বসছে। এ ভাসমান হাটে এক শ্রেণীর অসাধু বেদে মাছ ব্যবসায়ী কৌশল অবলম্বন করে ইলিশকে পদ্মা-মেঘনা নদীর তাজা ইলিশ বলে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে। লঞ্চে করে যাওয়ার জন্যে আসা যাত্রীরা ক্রেতা হিসেবে ইলিশ পন্টুনে বা লঞ্চ থেকে ক্রয় করার পর প্লাস্টিকের ব্যাগে বরফ দিয়ে ভাল ইলিশ না দিয়ে পচা ইলিশ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এতে করে প্রতিদিন ক্রেতারা এ ইলিশ মাছ ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পাচ্ছে পচা ইলিশ, যা খাওয়ার উপযুক্ত না। এভাবে ক্রেতারা মারাত্মকভাবে প্রতারিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাছ বিক্রেতা বেদেদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, এক সময় নদীতে বেদেরাই মাছ ধরতো, সাপের খেলা দেখাতো, তাদের মহিলারা ফেরি করে লেইচ ফিতা বিক্রি ও মানুষকে সিংগা দিয়ে অর্থ উপার্জন করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো। কালের বিবর্তনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ভালো বংশের লোকেরা মাছের ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে। এখন নদীতে বড় বড় জাল ও কারেন্ট জালের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আহরণ করে থাকে তারা। সে মাছ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে যাচ্ছে। এভাবে এখন অর্থশালী অনেকেই এ পেশায় জড়িত হয়ে পড়ছে। আদিযুগ থেকেই যাদের পেশা মাছ ধরা ও বিক্রি করা, সেই বেদেরা অর্থের অভাবে বড় জাল ও ট্রলার দিয়ে মাছ আহরণ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন বাজারেও ফেরি করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে বেদেরা। এখন বেদেরা তাদের সন্তানদের মাছ বিক্রি ও অন্য পেশা বাদ দিয়ে পড়ালেখা শিখিয়ে সমাজের উচ্চ আসনে বাসানোর চিন্তা করছে। তাদের চোখ এখন উপরের দিকে। অনেক বেদে পরিবার শিক্ষা অর্জন করে তাদের সন্তানদের নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে সমাজের বিভিন্ন ভালো মানের পেশায় নিয়োজিত করছে। তারা নদীতে যে মাছ ধরতো সে মাছ বাজারে বা আড়তে না নিয়ে ট্রেন স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড ও লঞ্চঘাটে নিয়ে অধিক লাভের আশায় বেশি দামে বিক্রি করছে। এছাড়া কিছু কিছু বেদে মাছ বিক্রেতা নৌকায় করে খেয়াঘাট, ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটে বিভিন্ন প্রকার মাছ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। তারা ভালো মাছের সাথে পচা ও খারাপ ইলিশ মিশিয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করছে। ৮/১০টি নৌকা মেঘনা নদীতে একসাথে জড়ো করে ভাসমান ইলিশের হাট বসায় তারা। তারা উচ্চ স্বরে ইলিশ আছে বলে আওয়াজ দিয়ে লঞ্চযাত্রী ক্রেতাদের ইলিশ কেনার জন্য আকৃষ্ট করে থাকে। ৭-৮শ’ গ্রামের ৪টি ইলিশের দাম হাঁকায় ৪ হাজার টাকা। ক্রেতা সাধারণ বুঝে না বুঝে অর্ধেক দাম ২ হাজার টাকা বা ২২শ’ টাকা বলে। তারপর তারা দাম একটু বাড়াতে বলে। বাধ্য হয়ে ক্রেতা ২৪শ’ বা ২৫শ’ টাকা বললে তারা ৩ হাজার টাকা বলে নদী থেকে ইলিশ ব্যাগ ভর্তি করে বরফ দিয়ে মুখ বেঁধে দিয়ে নৌকায় থেকেই লঞ্চে বা পন্টুনে পাঠিয়ে দেয়। ক্রেতা সাধারণ বাড়িতে নিয়ে দেখে ৪টিই ইলিশের মধ্যে ১টি বা ২টি পচা বা নরম হয়ে গেছে। অনেকে বলেছে, ৪টি ইলিশের মধ্যে ৪টি পচা। এভাবে তারা প্রতিদিন ভাসমান হাট থেকে ইলিশ ক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছে। প্রতিদিন চাঁদপুর লঞ্চ ঘাটে শত শত যাত্রী নদী পারাপার হয়ে থাকে। এসব যাত্রীর নিকট সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত এভাবে ভাসমান ইলিশের হাট বসিয়ে হাজার হাজার টাকায় মাছ বিক্রি করে যাচ্ছে। বেদে মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, তারা প্রতিদিন সর্বমোট লাখ টাকা পর্যন্ত মাছ বিক্রি করছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর বড় স্টেশন আড়ত থেকে দক্ষিণাঞ্চলীয় ভালো-খারাপ দু’রকমের মাছ তারা কম দামে ক্রয় করে বরফ দিয়ে শক্ত করে এবং সে মাছ তারা পদ্মা-মেঘনা নদীর মাছ বলে বেশি দামে বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এই ইলিশ ক্রয় করে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে তথা ঠকছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর নৌ-বন্দরের দায়িত্বে থাকা টিআই মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, এখানে সাধারণ মানুষ মাছ বিক্রি করে বলে আমরা কিছু বলি না। এ ব্যাপারে যেহেতু যাত্রীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে, এখন আমরা এ বিষয়টির ব্যাপারে ব্যবস্থাগ্রহণ করবো। এ ছাড়া নৌ-টার্মিনাল থানার ওসিকেও বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে বলবো।