• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছে

আন্তঃনগর মেঘনা ট্রেনের ভাড়া ২-৩ গুণ ॥ সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

প্রকাশ:  ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০১:০২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রেলপথে ঈদের ১৩ দিন পরও  যাত্রীরা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে টিকেট ক্রয় করতে না পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিনা টিকেটে গন্তব্যে যাওয়ার জন্যে ট্রেনের ছাদে উঠে বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্যে যাচ্ছে। চাঁদপুর স্টেশনে রেলওয়ের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী অবৈধ পন্থায় ট্রেনের ছাদে উঠে ভ্রমণ করা যাত্রীদের বাধা প্রদান না করায় যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে উঠে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এতে করে সরকার প্রতিদিন সহস্রাধিক যাত্রী থেকে রাজস্ব না পেয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এছাড়া চাঁদপুরে মেঘনা ও সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ভাড়া দ্বিগুণ ও  তিনগুণ দিয়ে যাত্রীরা  চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে প্রতিদিন যাত্রী হয়রানি চরম আকার ধারণ করেছে।
    চাঁদপুর স্টেশন টিকেট কাউন্টারের বাইরে মেঘনা এক্সপ্রেসের প্রথম শ্রেণীর টিকেট ২৬০ টাকা বিক্রির স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৭শ’ টাকা, শোভন চেয়ার ২য় শ্রেণীর টিকেট ১৯৫ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪শ’ ৫০ টাকা, শোভন শ্রেণীর টিকেট ১৬৫ টাকার স্থলে বিক্রি হচ্ছে ৪শ’ টাকা, সাগরিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট ৮০ টাকার স্থলে ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। অপর দিকে চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনের হাতে লেখা টিকেট চাঁদপুর বড় স্টেশনে এনে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা বুকিং ক্লার্ক শফিকুর রহমান ১৬৫ টাকার টিকেট ২শ’ টাকায় বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ জানান স্টেশন লাগোয়া চাঁদপুর হোটেলের ম্যানেজার মোঃ রফিকুল ইসলাম ও শহরের নূর ম্যানশনের নাইট গার্ড মোঃ সেলিম মিয়া গাজী। তাদের কাছে ৩টি টিকেট ৬শ’ টাকা বিক্রি করেছে বলে তারা প্রতিবাদ করলে তাদেরকে টিকেট দিয়ে টাকা ফেরৎ নিতে বলেন। এতে করে অধিক টাকায় টিকেট ক্রয় করে এক দিকে যাত্রীরা প্রতারিত হচ্ছে।
    আরো জানা গেছে, গত ২৩ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ঈদ স্পেশাল ট্রেনের টিকেট ১০০ টাকার স্থলে ১২০টাকা ও ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে যাত্রীদের হয়রানি করে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে স্থানীয় চাঁদপুর কোর্ট ও চাঁদপুর বড় স্টেশনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় অসাধু কালোবাজারীরা। একজন যাত্রীর অভিযোগ, এখানে দীর্ঘদিন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আবদুস সালামের সাথে মুঠোফোনে প্রথম শ্রেণীর একটি টিকেট চাওয়া হলে তিনি জানান, এক লক্ষ টাকা দিলেও একটি প্রথম শ্রেণীর টিকেট দেয়া যাবে না। বিকল্প চিন্তা করেন, অন্য টিকেট নিবেন কিনা। এখন অনলাইনে সব টিকেট চলে যায়। আমার ইচ্ছায় কিছু হয় না। সাগরিকার টিকেটের দায়িত্ব আমাদের নেই।
    খবর নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা বরিশাল, ভোলা, লালমোহন, লেতরা, পাতারহাট, কাউখালী, পয়সারহাট, ভান্ডারিয়াসহ বিভিন্নস্থান থেকে চাঁদপুর এসে চট্টগ্রাম যাওয়ার মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট ক্রয় করতে গিয়ে তাদেরকে বিড়ম্বনা সহ্য করতে হচ্ছে। তারা রেলওয়ের টিকেটের মূল্যের চাইতে দ্বিগুণ-তিনগুণ দিয়ে কিনে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে প্রতিদিন। অধিকাংশ দক্ষিণাঞ্চলীয় যাত্রীরা টিকেট বুকিং কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে অধিক টাকায় টিকেট ক্রয় করছে। এ সুযোগ গ্রহণ করেছে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের নাম ভাঙ্গিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তিরা। তারা রাতের আঁধারে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।  
    ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানান, অসাধু ব্যক্তি ও রেলওয়ের টিকেট বিক্রির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করছেন রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। তারা যাত্রীদেরকে কাউন্টার থেকে টিকেট ও টাকা বুঝে নেয়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিচ্ছে না। টিকেট বিক্রিতে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে বলে কথা বলার পূর্বেই লাইন থেকে বের করে দেয়। কাউন্টারে টিকেটের জন্য  ৫শ’ বা ১ হাজার টাকার নোট দেয়া হলে কাউন্টার থেকে টিকেট ও টাকা একসাথে মুচড়িয়ে দিয়ে দেয়া হয়। সে টাকা খুলে দেখার কোনো সুযোগ থাকে না যাত্রীদের। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রহরী কালাম জানান, যে টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি নেয়া হয়, সে টাকা ১৫টি সংস্থার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এর একটি অংশ সাংবাদিকরাও পেয়ে থাকেন। এ টিকেট কালোবাজারি বিগত ৩০ বছর যাবৎ হয়ে আসছে। এ টিকেট বিক্রি ও টিকেট রি-সেলিং করে বিগত দিনে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা  শহরে বাড়ি-গাড়ি করে বসে আছে। তাদের কোনো কিছুই হচ্ছে না। বিগত দিনে হাতে লেখা টিকেট ছিল, তখন সুযোগ ছিল প্রচুর। এখন সে সুযোগ কম।
    যাত্রীদের অভিযোগ শুনতে শুনতে অবশেষে চাঁদপুর শহরের কয়েকজন সংবাদকর্মী গত বুধবার ভোর রাতে চাঁদপুর স্টেশন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জানতে পারেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকার হাজার হাজার যাত্রী ঈদে আত্মীয় স্বজনের সাথে ঈদ করার জন্য বাড়িতে আসেন। গত ২২ আগস্ট ঈদ পালিত হলেও তারা দীর্ঘদিন পরে চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছে কর্মস্থলে। যাত্রীরা জানান, চাঁদপুর স্টেশনে এসে দেখতে পায় রেলওয়ের টিকেট কাউন্টারে পর্যাপ্ত টিকেট নেই। যাত্রীরা টিকেট কাউন্টারের সামনে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ৩টি টিকেট চাইলে তাদেরকে ২টি টিকেট দেয়া হয় নাম্বার ছাড়া ও ১টি টিকেট দেয়া হয় নাম্বার সম্বলিত। ৫টি টিকেট চাওয়া হলে ৩টি দেয়া হয় নাম্বার ছাড়া, ২টি দেয়া হয় নাম্বারসহ। প্রতিটি টিকেটের মূল্য নেয়া হয় দ্বিগুণ। মূল্য বেশি কেন নিয়েছেন এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করলে টিকেট কাউন্টারের সামনে দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিবাদী যাত্রীকে গাঢ় ধাক্কা মারে অথবা লাঠিচার্জ করে বলে একাধিক যাত্রী অভিযোগ করে জানান এ প্রতিনিধিকে। এছাড়া এ দৃশ্য সংবাদকর্মীদের সামনেও ঘটেছে। গতকাল চাঁদপুর স্টেশনে টিকেট কাউন্টারের দায়িত্বে ছিলেন মোঃ রফিকুল ইসলাম। তার সাথে টিকেট কাউন্টারের বাইরের অংশে থেকে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার এখানকার কর্মকর্তারা যেভাবে টিকেট বিক্রি ও দিতে বলেছে সেভাবে দিচ্ছি। যাত্রীরা জানান, বুকিং কাউন্টারে টিকেট না পেলে বাইরে টিকেট ক্রয় করা যায় সচরাচর। প্রতিটি টিকেট বেশি দামে ক্রয় করলে ট্রেনের আসন পাওয়া যায়। যেসব যাত্রীর কাছে বেশি টাকা আছে তারা বাইর থেকে বেশি টাকায় টিকেট ক্রয় করে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছে। যাদের কাছে অতিরিক্ত টাকা নাই, তারা বিনা টিকেটে যাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুরা ছাদের উপর বৃষ্টিতে ভিজে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া মেঘনা এক্সপ্রেসের ২১টি ট্রেনের বগির ছাদের উপর কমপক্ষে সহ¯্রাধিক যাত্রী চট্টগ্রাম গিয়েছে বলে চাঁদপুর স্টেশনে দায়িত্বে থাকা রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এতে করে সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা রাজস্ব আয় বঞ্চিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, বৃহস্পতিবার চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম টিকেট বিক্রির মাধ্যমে যাত্রী গিয়েছে ১৫২৯ জন। এতে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে ২ লক্ষ ২০ হাজার ২শ’ ৭০ টাকা। এছাড়া বাইরে কালোবাজারে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তিরা প্রতিটি টিকেট দ্বিগুণ ও তিনগুণ দরে বিক্রি করে যাত্রীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করে জানান।
    এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের যাত্রী সালমান (বাড়ি পিরোজপুর কাউখালী) জানান, টিকেট কাউন্টার থেকে শোভন শ্রেণীর ১৬৫ টাকা মূল্যের ২টি টিকেট ক্রয় করেছি ৫৮০ টাকা দিয়ে। তার মধ্যে একটির আসন রয়েছে যার নং-ঈউজ০০৪১০/৬৪, আপরটির টিকেট নাম্বার হচেছ, ঈউজ০০৪১ড়/০৬।
     এ ব্যাপারে বরিশাল থেকে চাঁদপুর এসে চট্টগ্রাম যাওয়া যাত্রী মোঃ আরিফ হোসেন জানান, টিকেট বুকিংয়ে ৩টি টিকেটের বিপরীতে আমার কাছ থেকে শোভন শ্রেণীর জন্য ৯৩০ টাকা রেখেছে। ২টি সিট দিয়েছে।  একটি সিট দেয় না।
    বরিশাল থেকে চাঁদপুর এসে চট্টগ্রাম যাওয়া যাত্রী আল-আমিন জানান, শোভন শ্রেণীর ১৬৫ টাকার ২টি টিকেটের দাম নিয়েছে ৫৮৫ টাকা। তারপর আসন দেয়নি। প্রতিবাদ করায় ঊঢঞঅ-৩ বগিতে একটি আসন দিয়েছে। আসন নং-৩৩।
     এ ব্যাপারে চাঁদপুর স্টেশনে কর্মরত বুকিং ক্লার্ক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, আমি এ ব্যাপরে কিছু বলতে পারবো না। আমার এখানকার কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন, তারা সব কিছু বলতে পারবে।
     এ ব্যাপারে চাঁদপুর স্টেশনে কর্মরত ভারপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মোঃ শোহেব শিকদার জানান, টিকেটের অতিরিক্ত দাম নেয়া হয় এ বিষয়টি এখন জানলাম। ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে আমরা লিখিতভাবে অভিযোগের মাধ্যমে জানাবো। তারপর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
    এ ব্যাপারে চাঁদপুর স্টেশন মাস্টার মোঃ জাফর আলম জানান, আমি ছুটিতে আছি। এ ব্যাপারে যেহেতু জেনেছি, তবে অবশ্যই তাদের  বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন  কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাগ্রহণ করবো।

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ

সর্বাধিক পঠিত