বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)
মোঃ নূর ইসলাম খান অসি
বৃটিশ শাসিত একটি অবহেলিত মহকুমার নাম গোপালগঞ্জ। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার অর্ন্তগত (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা) একটি অখ্যাত গ্রাম ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় টুঙ্গীপাড়া। সে গ্রামে সুদূর মক্কা থেকে আগত এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ খ্রিঃ ১৭ মার্চ পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ঔরষে ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের গর্ভে জন্ম নিলেন শিশু মুজিব। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
যিনি পরবর্তীতে স্বীয় যোগ্যতা, প্রতিভা ও নেতৃত্বের গুণে শিশু মুজিব হতে ধীরে ধীরে মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, সর্বোপরি জাতির জনকে পরিণত হন। তিনি শুধু বাঙালি জাতির জনকই নন বরং তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির অগ্রদুত।
শিশু মুজিব বাড়ন্ত বট বৃক্ষের মত ধাপে ধাপে বাঙালি জাতির সামনে উদ্ভাসিত হলেন। শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, দেশবন্ধু, নেতাজী সুভাষ বোস, মাওলানা ভাসানীর অনুপ্রেরণায় শেখ মুজিব প্রতিটি স্বদেশী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ও সংগ্রামে প্রথম কাতারে উঠে এলেন। তাঁর পদচিহ্ন ধরেই ক্রমান্বয়ে বাঙ্গালী জাতি এগিয়ে চলেছে। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে এই অবহেলিত নির্যাতিত, শোষিত সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মর্মবাণী। তাঁর চোখে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তিমির রাত্রির অবসানে প্রতীক্ষা ব্যাকুল বাঙ্গালী জাতির আকাঙ্খিত আলোকোজ্জ্বল প্রভাতের স্বপ্ন। এক কথায় বাঙ্গালী জাতিই যেন শেখ মুজিব- আর শেখ মুজিবের অপর নাম বাঙ্গালী জাতি। এমনি করেই তিনি জাতির সত্ত্বায় অস্তিত্বে একাকার হয়ে গেছেন। বিশ্বের অন্যকোন জননেতার পক্ষে যা সম্ভব হয়নি। এখানেই তিনি চিরকালের মত ব্যতিক্রম।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সরলতার সুযোগ নিয়ে মীরজাফর গং বিশ্বাসঘাতকতা করে। যার ফলে আমরা বাংলার স্বাধীনতা হারাই এবং ১৯০ বৎসরের জন্য ব্রিটিশদের গোলামীর জিঞ্জিরে বন্দী হই। এরপর বহু ত্যাগ, তিথীক্ষা সংগ্রাম ও রক্তের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট একটি অনাকাংখিত স্বাধীনতা লাভ করে বাঙ্গালী জাতি। পাকিস্তানীরা জাতি ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে পূর্ব বাংলায় বিভেদ ও বৈষম্যের প্রাচীর সৃষ্টি করলো। তিনি বুঝলেন, ইংরেজ বিদায় নিয়েছে সত্য, কিন্তু হাত বদল হয়ে নতুন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এদেশের মাটিতে তার সর্বনাশা নখর বিস্তার করেছে। ১৯৪৮ সালের সুপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিল পাকিস্তানী কুচক্রী’র দল। শেখ মুজিব তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে নিজের জীবন বাজী রেখে উলকা গতিতে ছুটে গেলেন দাঙ্গা বিক্ষুদ্ধ প্রতিটি মহল¬ায়। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে অল্পতেই থেমে গেল ভাইয়ে ভাইয়ের রক্তের হোলি খেলা।
১৯৪৮ সালে গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, ঢাকার নবাব নাজিম উদ্দিন ও নুরুল আমীনসহ এদেশীয় দোসরগণ পল্টন ময়দান ও কার্জন হলে ঘোষণা দেন, “উর্দ্দু, উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা”। মুজিবের তারুণ্য দৃপ্ত কন্ঠে প্রতিবাদী সোচ্চার না-না। সেই কন্ঠের সঙ্গে হাজারো কন্ঠে প্রতিধ্বনি তুললো, “না-না-না। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।” সেদিন রাত্রেই মুজিবের নেতৃত্বে গঠিত হলো বাংলার প্রাণপ্রিয় বিপ¬বী ছাত্র সংগঠন “পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ”। এ প্রতিবাদকে মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানী নরপশুগণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবীর পক্ষে কথা বলায়, মায়ের ভাষার পক্ষে কথা বলায় প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় হতে নাম কেটে দিল। তাতেও কিছু না হওয়ায় মুজিবকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। চক্রান্তকারীরা সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অঙ্কুরেই ধ্বংস করার মানসে শুরু করলো বাঙ্গালীদের প্রতি চরম অত্যাচার ও নির্যাতন। মুজিবের নেতৃত্বে ইতোমধ্যে তৈরী হওয়া “ভাষা সংগ্রাম কমিটি” সাংগঠনিকভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এর কর্মীগণ নেতা মুজিবের অনুপ্রেরণায় সারাদেশে গড়ে তুললো দুর্বার গণআন্দোলন। গণ অসন্তোষ তখন চরম আকার ধারণ করেছে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পৃথিবীতে আমরাই রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে পেলাম। এর নেপথ্য নায়ক তৎকালীন উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর হলো ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। সেদিন জননেতা জনাব সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা ও মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে ঐতিহাসিক নির্বাচনী জোট গঠিত হলো তার প্রাণ পুরুষ ও মূলচালিকাশক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। ব্যালটের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি সেদিন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে যেভাবে উৎখাত করলো, দুনিয়ার ইতিহাসে তার নজির মেলা ভার।
১৯৫৮ সালের ২৮শে অক্টোবর গভর্ণর ইস্কান্দার মীর্জাকে সরিয়ে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে। সামরিক শাসন জারি করে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার হরণ করা হলো। এরপর ৬২এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর বাঙ্গালী জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন। ৬৯ এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলাসহ প্রতিটি আন্দোলনের সফল রূপকার শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙ্গালীদের পক্ষে কথা বলার অজুহাতে বারবার বঙ্গবন্ধু মুজিবের সুযোগ্য সহকর্মীদের আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করলো পাকিস্তাানের লৌহমানব আইয়ুব খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। মুক্তি দিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু মুজিবের মুক্তির অধিকার বিনা সংগ্রামে চেয়ে পাওয়া যাইনি। এজন্য অনেক ত্যাগ, রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছিল বাঙালী জাতিকে। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান সার্জেন্ট জহুরুল, ছাত্র নেতা আসাদ, কিশোর মতিউর, শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, শিক্ষক ডাঃ জোহাসহ শত শত দেশ প্রেমিক ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব’ ভক্তকে নিঃসঙ্কোচে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
‘শেখ মুজিব’-মুজিব ভাই হতে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। বাংলার আকাশে বাতাসে শুধু মুজিবের জয়ধ্বনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রনেতা, বুদ্ধিজীবী সবাই একত্রিত হলো। তারা বুঝতে পারলো মুজিব ছাড়া এ শৃংখল মুক্তির উপায় নেই। মুজিবের নেতৃত্বেই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু মুজিব বাঙালীদের শিখিয়েছেন--দেশ মাতৃকার জন্য আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বুক উঁচু করে দাঁড়াবার। গণ আন্দোলনে আইয়ুব খান গদিচ্যুত হলেন। ক্ষমতার রঙ্গমঞ্চে আবির্ভাব ঘটলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ভিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের। ছলনার আবরণে তিনি তার আসলরূপ গোপন করে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন। জনচিত্তের ক্রোধ আপাততঃ প্রশমিত হলো। কিন্তু সেই মুহুর্তে বাঙ্গালীর ভাগ্যাকাশে দেখা দিল আর এক মুসিবত। ১৯৭০ সালে দেশের সমগ্র উপকূল এলাকায় সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ বাঙালী মারা গেল। পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠী বাঙালীর চরম দুর্দিনে সামান্যতম সমবেদনা জানালো না। বঙ্গবন্ধু ছুটে গেলেন জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এলাকায়। আগে মানুষ বাঁচাও পরে নির্বাচন। পশ্চিম পাকিস্তানীদের এহেন বিমাতা সুলভ আচরণে ও বঙ্গবন্ধুর দেশ ও জাতির প্রতি ভালবাসা বাঙালীদের আরো জোটবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করলো। করলো দেশাত্মবোধে জাগ্রত। ‘ইন্হাস্তওয়াতানম’। এ বাংলা মাকে মোগল, পুর্তগীজ, বর্গী, ব্রিটিশ বেনিয়া, স্বৈরাচারী পাকিস্তানীরাসহ হায়েনার দল যুগে যুগে শাসন-শোষণই করেনি-করেছে অত্যাচার, অপমান, ধর্ষণ ও রক্তশোষণ। এবার প্রতিশোধ নেবার সুযোগ এসেছে তাই ৭০-এর নির্বাচনে বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু মুজিবের নৌকা প্রতীকে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট দিল।
স্বৈরাচারী পাকিস্তানীগণ ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে তালবাহানা শুরু করলো। মুজিব ডানে গেলে ভুট্টো-ইয়াহিয়া যায় বায়ে। বাঙালীরা তখন অনেক সাহসী, অনেক বেশি সচেতন। বঙ্গবন্ধু মুজিব তাদের শিখিয়েছেন, “এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”
বঙ্গবন্ধু মুজিব বাঙালী জাতিকে কি সঞ্জীবনী সুধা পান করিয়ে ছিলেন তা ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভা যে না দেখেছে সে বুঝতে পারবে না। তিতুমীরের বাঁশের কেল্ল¬া আমরা দেখিনি, সূর্য সেনের চট্টগ্রামের অগ্নিযুদ্ধ আমরা দেখিনি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মুজিবের ৭ই মার্চের অনন্য সাধারণ ঐ দিনের ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান আমাদের অনেকেরই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এটা ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সংগ্রামী গণ সমাবেশ। স্বাধীনতাকামী মানুষের বাঁধভাঙ্গা ঢল। আকারের বিশালতায়, অভিনবত্বের অনন্ত মহিমায়, সংগ্রামী চেতনার অতুল বৈভাবে ঐ জনসমুদ্র ছিল নজিরবিহীন। বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের মহানায়ক শ্বেতশুভ্র বসন ও মুজিব কোট পরিহিত বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। আমি যদি হুকুম-----এবারের সংগ্রাম---আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম---আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মুজিবের নির্দেশে মুজিবের আদর্শে মুজিবের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলো বাঙালী জাতি। তারা জানিয়ে দিল “আমরা হারবোনা-হারবোনা, তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বো না।” বাঙালী জাতি তাদের পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। আলোচনার নামে অযথা সময়ক্ষেপণ করে হানাদার পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তান হতে অস্ত্র-শস্ত্র ও সৈন্য আনতে শুরু করলো। বাংলার শোষিত বঞ্চিত মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে রেখে তাদের অর্থে কেনা অস্ত্র দিয়ে প্রতিদিন হত্যা করতে লাগলো বাঙালীকে। পশ্চিম পাকিস্তান হতে ভুট্টো এসে মুজিবকে নানা প্রলোভনের টোপ দিলেন। বঙ্গবন্ধু মুজিব দৃঢ়কন্ঠে জানালেন, “বাংলার জনগণ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তার সাথে আমি বেঈমানি করতে পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, বাংলার মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তি চাই।”
ইতোমধ্যে অস্ত্র ভর্তি “সেয়াত” জাহাজ চট্টগ্রামে এসে পড়েছে। এলো ২৫শে মার্চ কালোরাত্রি। ঐ দিনই রাতের আঁধারে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নিরস্ত নিরপরাধ বাঙালীদের উপর স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। রাজপথ হলো রক্তের নদী, চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা। বিভিন্ন সূত্র থেকে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু মুজিব-এর কাছে পাকিস্তানীদের ব¬ু প্রিন্টের খবর এসে গেল। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ওয়ারলেসের এর মাধ্যমে চট্টগ্রামে আওয়ামীলীগ নেতাদের কাছে স্বাধীনতার চুড়ান্ত ঘোষণা পাঠান। যা আওয়ামীলীগ নেতা এম.এ. হান্নান ২৬শে মার্চ একাধিকবার রেডিওতে প্রচার করেন। জল¬াদ নরঘাতক ইয়াহিয়া খান রেডিও ভাষণে বলেন যে, “মুজিব ইজ এ ট্রেইটর টু দ্যা ন্যাশন, দিস টাইম হি উইল নট গো আন পানিসড্।” যে মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি, বাঙালীর মুক্তি চায়নি, বাংলাদেশ চায়নি, তাহলে ইয়াহিয়া খানের খাতায় তার নাম কেন ? সেক্টর কমান্ডার ‘জেড ফোর্সের অধিনায়ক’ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেব ১৯৭৪ সালের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় “একটি জাতির জন্ম” নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রীণ সিগন্যাল মনে হয়েছিল।” যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২৭শে মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে গ্রীণ সিগন্যাল মনে হয়েছিল।” যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২৭শে মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার সংগঠক বেলাল মোহাম্মদের অনুরোধে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে যে ঘোষণা পত্রটি পাঠ করেন তাতে তিনি বলেন, Major Zia declared the indeopendence of Bangladesh on behalf of our great national Leader Bangabandhu Shaikh Mujibur Rahman এর পরেও কি স্বাধীনতার ঘোষক, স্থপতি জাতির জনক নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে ? হায়রে সেলুকাস, সত্যিই এ এক বিচিত্র দেশ ! বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ বাঙালীকে রক্ষার জন্য সহকর্মীদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে আত্মগোপন না করে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি নিয়ে ছিলেন জীবনের ঝুঁকি।
ইতোমধ্যে সারাদেশে দেশ প্রেমিক সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র শিক্ষক, শ্রমিক, জনতা যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুকে রুখে দাঁড়ালেন। বঙ্গবন্ধুকে ধ্যানে জ্ঞানে রেখে তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তি সংগ্রামে। পার্শ্ববর্তী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে গিয়ে স্বল্প মেয়াদী গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এলো স্বদেশ বিজয়ে। ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর সরকার গঠন করা হলো। তার প্রধান হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী জীবন মরণ সংগ্রামে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার সূর্য আবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার পূর্ব দিগন্তে উদিত হলো। “পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে ................................. রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল।”
বাঙালী জাতি আবার হাজার বছর পর একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পেল, জাতীয় পতাকা ও সঙ্গীত পেল, কিন্তু তার স্বপ্নদ্রষ্টাকে পেলনা। কারণ বঙ্গবন্ধু মুজিব তখন পাকিস্তানীদের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করছেন, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। বাঙালীর হৃদয়ে তখন কারবালার মর্শিয়া। কেহ রোজা রাখে, নফল নামাজ পড়ে, আবার কেহ ঠাকুর বাড়ীতে পূজা দেয় যেন তাদের প্রিয় নেতা জীবিতাবস্থায় স্বাধীন বাংলার বুকে ফিরে আসে। বহু চড়াই উৎড়াইয়ের পর পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বিশ্ববাসীর চাপের মুখে বাঙালীর নয়ন মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে-তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে মায়ের বুকে ফিরে এলেন।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। খাদ্য, বস্ত্র, অর্থ কিছুই নেই। সীমাহীন অভাব ও অপরিসীম চাহিদার মধ্যে শূণ্য হাতে বাংলার মসনদে বসলেন মুকুটহীন সম্রাট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিভিন্ন মুখী অসুবিধার মধ্যেও তিনি যখন ধীর পদক্ষেপ শোষণমুক্ত “সোনার বাংলা” গড়ার দৃপ্ত প্রত্যয় এগিয়ে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক চক্র ও তাদের এদেশীয় পদলেহী মানুষ্যরূপী পশুরা মেনে নিতে পারেনি। কারণ বঙ্গবন্ধু মুজিব শুধু বাঙালী জাতির জনক নন, বাংলাদেশের স্থপতি নন, স্বাধীনতার ঘোষক নন, তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ‘মুক্তির অগ্রদূত’। সকল দেশের জাতীয় ও মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক চক্র ও তাদের এদেশীয় পদলেহী নরকের ঘৃণ্যকীটেরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করে দিলেন। তারই পরিণতিতে এ দেশীয় কুলাঙ্গার ঘরের শত্রু বিভীষণ সাম্রাজ্যবাদী চক্রের দালাল নরপশু মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, কর্ণেল ফারুক, কর্ণেল রশিদ, মেজর ডালিমসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কালো রাত্রিতে বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে।
কাঁদো বাঙালী কাঁদো, জাতির পিতার জন্য কাঁদো, বাংলার স্বপ্ন স্রষ্টার জন্য কাঁদো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর যারাই ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিলেন তারা প্রতিনিয়ত রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকাসহ সকল প্রচার মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও তার সর্বাধিনায়ক এবং সিপাহশালারদের বিরুদ্ধে বিকৃত ইতিহাস ও কুৎসা প্রচার করে- এদেশের স্বাধীনতা উত্তর নতুন প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষকে করেছে বিভ্রান্ত। নির্লজ্জ ও গোয়েবলসীয় রীতি প্রচারে ফলে তারা এখন সত্য ও মিথ্যা পৃথক করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। জাতির জনকের রক্তের ঋণ শোধ করার সময় এসেছে। তাইতো তারা সগৌরবে তাদের মনের মনিকোঠায় বাংলার ঘরে ঘরে জাতির জনকের যোগ্য স্থান দিয়েছে। ১৯৯৬-এর ১২ই জুনের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ তাঁর সুযোগ্যা কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিজয়ী হয়ে ২৩শে জুন পুনরায় বাংলায় সিংহাসনে আসীন হয়। ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮ ব্রুট মেজুরিটি নিয়ে ২য় বারের মত মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। জাতির জনক এর কতিপয় হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। ৮ই নভেম্বর,২০১০ বাঙালী জাতির জন্য স্মরণীয় দিন, দীর্ঘ দু’যুগ পর বাঙালী জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্ক মুক্ত হলো।
জাতির জনককে নিয়ে সম্প্রতি মুখচেনা গোষ্ঠীর বিতর্ক সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিতে চাই, ১৯৭৫ সালের ১৫ই জানুয়ারি ৪র্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। ঐ সংশোধনীর ৩৫ অনুচ্ছেদের ই অংশে পরিস্কার উলে¬খ আছে, BANGBANDHU SHEIKH MUJIBUR RAHMAN, FATHER OF THE NATION, ............THE CONSTITUTION AS AMENDED BY THE ACT ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর সামরিক আদেশ এবং অর্ডিন্যান্স বলে জেনারেল জিয়া সংবিধানের এই ৪র্থ সংশোধনীর অনেক ধারা বাতিল করেছেন। আবার ইনডেমনিটি বিলসহ অনেক অগণতান্ত্রিক ধারা সংযোজন করেছেন। কিন্তু ৪র্থ সংশোধনীর ৩৫ অনুচ্ছেদের ই ধারাটি বলবত রেখেছেন।
আজ আর কার্ফ্যু নেই, রাস্তায় নেই ঘাতকের ট্যাংক আর কামান। তথাকথিত সূর্য সন্তানেরা এখন নেড়ী কুকুর, ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত নরকের ঘৃণ্যকীট। মুজিব অতো ঠুন্কো নয়যে তাকে নশ্বর পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেই সব শেষ। ঘাতক পশুরা তখন বুঝেনি যে, জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব কোটি কোটি গুণ শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসবে এ বাংলায়। তাইতো প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় বলেছিলেন-
“যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা রহমান / ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”
বাংলাদেশে শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর সম্বন্ধে হেমিংওয়ের এ উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করা যায়। ঞরসব রং হড়ঃ সধফব ভড়ৎ ফবভবধঃ. গধহ পধহ নব ফবংঃৎড়ুবফ নঁঃ হড়ঃ ফবভবধঃবফ.
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়- এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু-বাংলার জয় হোক।
লেখক: মোঃ নূর ইসলাম খান অসি
নাট্যকার, প্রবন্ধকার ও সংগঠক ।
ছাত্র জীবনে দির্ঘদিন (১৯৭০-১৯৮৭) মুজিবাদর্শের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরিচালক- ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার । সভাপতি- বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। মোবা: ০১৮১১-৪৫৮৫০৭