• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

স্পিডবোট দুর্ঘটনা : নিহত ২৬ জনের মরদেহ হস্তান্তর

প্রকাশ:  ০৪ মে ২০২১, ১২:২৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ীর বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডের সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্পিডবোট ডুবিতে নিহতের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সোমবার (৩ মে) সকালে কাঁঠালবাড়ীর বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে পদ্মা নদীতে এ স্পিডবোট ডুবির ঘটনা ঘটে। মরদেহগুলো কাঠালবাড়ী হাজী ইয়াসিন মোল্লাকান্দি দোতারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে রাখা আছে। সেখান থেকে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।

পিডবোট দুর্ঘটনায় চালক শাহ আলম গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে পুলিশ হেফাজতে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি হলে ফরিদপুর মেডিকেলে পাঠানো হয়। তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।

মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে সোমবার সকাল পৌনে ৭টায় ৩০ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোটটি ছেড়ে আসে। এ সময় মাদারীপুর কাঁঠালবাড়ী বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে থেমে থাকা বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডে ধাক্কা দিয়ে ডুবে যায় স্পিডবোটটি। এসময় সব যাত্রী পানিতে পড়ে যান। পরে নদী থেকে একে একে ২৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এ উদ্ধার কাজ পরিচালনা করে।

ঘটনার পরপরই বাংলাবাজার ঘাট এলাকায় জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন, মাদারীপুর পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, ফায়ার সার্ভিসের ফরিদপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিবচর উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। এছাড়া বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, বরিশাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ডুবরি দল ও স্থানীয় ডুবরিরা লাশ উদ্ধার কাজে অংশ নেন।

স্পিডবোট দুর্ঘটনায় নিহত ২৬ নের পরিচয় জানা গেছে। এরা হলেন-খুলনার তেরখাদার একই পরিবারের মনির মিয়া ও তার স্ত্রী হিনা বেগম, দুই মেয়ে রুমি আক্তার ও সুমী আক্তার। ফরিপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ইয়ামিন (২), বরিশাল বন্দরের আনোয়ার চোকিদার (৫০), মাদারীপুরের শ্রিনদীর মাওলানা আব্দুল আহাদ, চাঁদপুরের উত্তর মতলবের মো. দেলোয়ার হোসেন, নড়াইলের লোহাগড়ার যুবায়ের মোল্লা (৩০), কুমিল্লার তিতাস থানার জিয়াউর রহমান (৩৮), কুমিল্লার দাউদকান্দির কাউসার আহমেদ (৪০) ও রুহুল আমিন (৩৫), মাদারীপুরের শিবচরের শাহাদাত হোসেন (৪২), মুন্সিগঞ্জের সাগর শেখ (৪১), ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার আরজু সরদার (৪০), মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার তাহের মীর (৩৫), বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের সাইদুর হোসেন (২৭) ও রিয়াজ হোসেন (৩৩), ঢাকা পীরেরবাগ ছাপরা মসজিদ এলাকার খোরশেদ আলম, ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার নাসিরউদ্দিন (৪৫), পিরোজপুর সদরের বাপ্পি (২৮), ভান্ডারীয়ার জনি অধিকারী (৩৫), বরিশালের মনির হোসেন (৩৫) ও আলা উদ্দিন (৪৪)।

এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (বিকেল ৫টা) স্বজনদের দেখানো মতে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করা গেছে। স্বজনদের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব হয়েছে বলেও জানা গেছে। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা আমির হোসেন সেরনিয়াবাদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

jagonews24

মুন্সিগঞ্জ সদর সাতরাপাড়া গ্রামের নিহত সাগর শেখের চাচাতো ভাই হিরা কান্নায় জড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ভাই আর নেই। ওর দুই মেয়ে। মেয়েরা কাকে ‘বাবা’ বলে ডাকবে?”

স্পিডবোটের জীবিত উদ্ধার হওয়া যাত্রী আদুরি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মায়ের লাশ দেখতে যাচ্ছিলাম। এখন স্বামী-সন্তানের লাশ নিয়ে আমাকে ফিরে যেতে হচ্ছে।’

কান্না করতে করতে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন আদুরি বেগম। তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে ঢাকায় আটকা পড়েছিলাম। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে বিচলিত হয়ে গ্রামে ফিরছিলাম। দেড় বছরের সন্তান ইয়ামিন আমার কোলে ছিল। স্পিডবোট অতিরিক্ত গতিতে চলছিল। আমি এক হাতে ছেলে ও আরেক হাতে স্বামীকে জাপটে ধরেছিলাম। হঠাৎ সজোরে ধাক্কা খেয়ে সকলেই ছিটকে পড়ি। আমি জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালে। সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে ফিরি। ততক্ষণে স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবর পাই।’

আদুরির চাচা বলেন, ‘বাড়িতে একটি কবর খুড়ে রেখে এসেছি। ফোনে আরও দুটি কবর প্রস্তুত করতে বলেছি। বিধাতা কেন আমাদের পরিবারের সঙ্গে এমন করল?’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে আমরা ঘটনাস্থলে এসে প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের সঙ্গে কথা বলি। লকডাউনের মধ্যে স্পিডবোট চলাচল বন্ধ থাকলেও শিমুলিয়া ঘাট থেকে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে স্পিডবোট পারাপার করেছে। যাত্রীদের কাছ থেকে দেড়শ টাকার স্থলে তিনশ টাকা করে নেয়া হয়েছে।’

jagonews24

‘জীবিত উদ্ধার তিনজন যাত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা বলেছেন চালক নেশাগ্রন্ত অবস্থায় বেপরোয়াভাবে স্পিডবোট চালিয়েছেন। নদীর মধ্যেও একবার দুর্ঘটনা কবলিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু ঘাটে এসে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে গেল।’
এদিকে মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানজিদা ইয়াসমিন (রাজস্ব) জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাশ দাফন করার জন্য নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন তাৎক্ষণিকভাবে দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় ছুটে যান এবং নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রদান করেন।

এ ঘটনায় মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও উপ-পরিচালক স্থানীয় সরকার বিভাগ আজাহারুল ইসলামকে প্রধান করে ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। যারা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হয়েছে।