• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

হঠাৎ দুটি করুণ মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন

তারাবীহ নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরা হলো না দুই বন্ধুর

প্রকাশ:  ২৫ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

দুই বাল্য বন্ধু সজিব মৃধা (১৭) ও আশিক মৃধা (১৮) পবিত্র মাহে রমজানের প্রথম তারাবীহ নামাজ একত্রে সদ্য উদ্বোধন হওয়া দৃষ্টিনন্দন ফরিদগঞ্জ মডেল মসজিদে আদায় করবেন বলে নিয়ত করেন। সেই অনুযায়ী মাগরিব নামাজের পর দুই বন্ধু তাদের মোটর সাইকেল নিয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরে আসেন। যথাসময়ে ফরিদগঞ্জ মডেল মসজিদে তারাবীহ নামাজও আদায় করেন। কিন্তু তাদের আর বাড়ি ফেরা হলো না, বাড়ি ফেরার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঘটনাস্থলে এক বন্ধু সজিব ও অপর বন্ধু আশিক চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। ফরিদগঞ্জে বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) রাতে এই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। শুক্রবার (২৪ মার্চ) বাদ জুমা তাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। একসাথে চলাফেরা করা দুই বন্ধু এভাবে একসাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া নিয়ে এলাকায় শোকের মাতম বইছে। নিহত দুটি পরিবারের কাছে দুই বন্ধুর তোলা মুঠো ফোনের সেলফিই এখন একমাত্র সম্বল।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান জানান, গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের চরমথুরা গ্রামের মৃধা বাড়ির নান্নু মৃধার ছেলে সজিব ও একই বাড়ির জসিম মৃধার ছেলে আশিক। বৃহস্পতিবার  ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরস্থ মডেল মসজিদে তারাবীহ নামাজ আদায় শেষে বাড়ি ফেরার পথে চরকুমিরা গোয়ালভাওড় সড়কের চরকুমিরা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। এদের মধ্যে সজিব ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন ও আশিককে চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিয়ন্ত্রণহীন মোটরসাইকেল চালানোর কারণে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। পরে রাতেই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতি নিয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) বাদ জুমা জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়। এ ব্যাপারে ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আঃ মান্নান জানান, দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। পরে উভয় পরিবার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ দাফনের অনুমতি নেয়।
ঘটনাটি পত্রিকার পাঠকের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার একটি সংবাদ। কিন্তু যেই দুটি পরিবারের দুটি উদীয়মান তারা হঠাৎ খসে পড়লো তাদের দিকে চিন্তা করলে মাথা চক্কর দেয়। সংবাদ সংগ্রহের জন্য শুক্রবার সকালে সজিব ও আশিকের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, একই বাড়ির দুই তরুণের মৃত্যু সংবাদে বিভিন্ন স্থান থেকে আত্মীয়-স্বজন ও আশপাশের মানুষ ছুটে আসছেন এবং হৃদয় বিদারক এই ঘটনার কথা শুনে চোখের পানি মুছতে মুছতে স্থান ত্যাগ করছেন। সকলের কথা, এসব অপ্রাপ্ত বয়সের (বয়স ১৭/১৮ হলেও নিয়ম না জানায় এই শব্দের ব্যবহার) ছেলেদের হাতে কেন মোটরসাইকেল তুলে দেয়া হচ্ছে। অভিভাবকরা কেন খোঁজ-খবর রাখছেন না, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন লাইসেন্সবিহীন ও নাম্বারবিহীন মোটরসাইকেল চলাচল রোধ করতে পারছে না, ঘটানস্থল পৌর এলাকা হলেও কেন সড়কে সড়ক বাতি নেইÑএসব নানা প্রশ্ন তারা উত্থাপন করছেন ভবিষ্যতে এসব ঘটনা আর না দেখার জন্য।
ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত সজিবের বাবা নান্নু মৃধার কাছে ছেলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলেন, ‘তিন মেয়ের পরে আমার সজিবের জন্ম। ছোট বেলা থেকেই তাকে আদরে আদরে রেখেছি। পড়াশোনা তেমন না করলেও ঢাকায় কাজ করতো। বাড়ি আসলেও তাকে কোনো কাজ করতে দেই নি। শবেবরাতের একদিন আগেই সে বাড়ি এসে জানায়, এ বছর সে আমার সাথেই রোজা থাকবে ও ঈদ পালন করবে। বৃহস্পতিবার বিকেলে জানায়, তারাবীহ নামাজ পড়তে ফরিদগঞ্জে যাবে। মাগরিব নামাজের আগেই তারা চলে যায়। আমি তারাবীহ নামাজ পড়ে বাড়ি আসার পর সজিবের মুঠোফোনে বারবার ফোন দিলেও সে রিসিভ করেনি। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় লোকজন জানায়, সজিব মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছে। রমজানের প্রথম তারাবীহ নামাজ আদায় করতে গিয়ে চিরতরে আমাদেরকে ছেড়ে চলেই গেল’।
নিহত আশিকের বাবা জসিম মৃধা জানান, ‘তিন ছেলের মধ্যে আশিক সকলের ছোট। ছেলে বোরকা তৈরিসহ টেইলারিংয়ের কাজ করতো। বাড়িতেই থাকতো। তার বাল্যবন্ধু সজিবের সাথে তারাবিহ নামাজ পড়তে গিয়েছিল কয়েকদিন আগে চালু হওয়া মডেল মসজিদে। কিন্তু ফিরে আসার পথে চরকুমিরা সড়কের মাহবুবুল বাশার কালু পাটওয়ারী বাড়ির অদূরে গাছের সাথে মোটরসাইকেল আঘাত খেলে দুর্ঘটনায় সে মারা যায়। এভাবে আমার প্রিয় আশিক আমাদের ছেড়ে চলে গেল, আমাদের এখন কী হবে’।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান দুর্ঘটনার বিষয়ে বলেন, কয়েকমাস পূর্বে সজিব, আশিকসহ আরো এক বন্ধু মিলে ১২ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোটরসাইকেল ক্রয় করে। সেই মোটরসাইকেল দিয়ে তারা নানাস্থানে যেতো। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর তারা তারাবীহ নামাজ পড়তে ফরিদগঞ্জে গিয়ে ফিরে আসার পথে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পড়ে। আমার অভিভাবক ও সকলের প্রতি অনুরোধ, এভাবে উঠতি বয়সের শিশু-কিশোরদের হাতে মোটরসাইকেল তুলে দিবেন না। একই সাথে অর্থ উপার্জনের জন্য অটোবাইক চালাতে না দেয়ার অনুরোধ করছি। ট্রাফিক ও সড়ক আইন না জানার কারণে প্রায়শই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একদিন পূর্বেও একই এলাকায় একটি দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারণে দুটি পরিবারে শোকের মাতম চলছে। যে ছেলেগুলো এখন পরিবারের জন্য সম্পদ হবে, তারা এখন লাশ হয়ে বাবার কাঁধে করে কবরে গিয়েছে।
স্থানীয় হকার্সলীগের সভাপতি সুমন জানান, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনে এই মোটরসাইকেল নিয়েই সজিব ও আশিক আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ঘটনা শুনে আমি দেখতে এসেছি।
চরমথুরা মৃধা বাড়িতে ঘটনা শুনে দেখতে যাওয়া কয়েকজন জানান, চরকুমিরা-গোয়ালভাওড় সড়কটি ক্রমেই ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটি আরো চওড়া হওয়ার সাথে সাথে পৌর এলাকার সড়কগুলোতে সড়ক বাতি লাগানো জরুরি। একই সাথে এভাবে শিশু-কিশোরদের মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করা, লাইসেন্সবিহীন মোটরযান নিষিদ্ধ করা জরুরি। নচেৎ আরো অনেক তাজা প্রাণ ঝরবে সড়কে।

 

 

সর্বাধিক পঠিত