• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

শিশুর বেড়ে ওঠা : পরিবারের দায়িত্ব

আহমদ আবদুল্লাহ

প্রকাশ:  ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:৫২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

একটি অঙ্কুর বৃক্ষে পরিণত করার জন্য বৃষ্টি, তাপ, পানি ও আলোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ঠিক তেমনি শিশুকে ভবিষ্যতের শিক্ষিত, আদর্শ ও সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিশুর অধিকার, ব্যক্তিত্ব, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, শিক্ষা, জীবনের নিরাপত্তা, স্নেহ ও ভালোবাসা, সামাজিক ও পরিবেশগত সদাচার, শিশুর সক্রিয় অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য প্রদান, নৈতিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখিত বিষয়গুলোর মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ থেকে যে অভিজ্ঞতা মনোবিজ্ঞানীরা অর্জন করেছেন, তাতে শিশুর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসেবে শিশুদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে শিশুর অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মেধার বিকাশ সাধন পরিবার ও সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে শিশু-অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। শিশু যদি জন্মের পর থেকে তার অধিকার ও দাবী থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে আমাদের এই অমার্জনীয় অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়। শিশু যেহেতু নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে কোনো ধারণা বা জ্ঞান রাখে না, তাই সমাজের মানুষের উপর তার এই দায়িত্ব পালনের জন্য কর্তব্যবোধ নির্ধারিত হয়েছে।
    শিশুদের     মন কোমল ও সজীব। নরম কাদার মত এই উর্বর মনে যা কিছু যে পরিবেশ বপন করা হবে তার ওপর নির্ভর করে শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মেধা তথা ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠা। তাই শিশুর অধিকারের প্রতি আমাদের দৃষ্টিপাত করা খুবই জরুরি। আমাদের বুঝতে হবে এই শিশুর একদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, জ্ঞানী-গুণী তারাই হবে। হবে ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাই তাদের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা স্বরূপ আচরণ করা। সর্বাস্থায় তাদের ওপর দৃষ্টি রাখা। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একবার এক ব্যক্তি রাসুল (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হলেন, তার সঙ্গে একটি শিশুও ছিলো। প্রিয়নবী (সাঃ) লোকটিকে বললেন, ‘তুমি কি এই শিশুর প্রতি দয়া করো?’ তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। নবী কারীম (সাঃ) বললেন, ‘তাহলে এই শিশুর প্রতি তুমি যতটুকু দয়া করবে তারচেয়ে বেশি আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন। তিনি দয়ালুর মধ্যে সবচে বড় দয়ালু।’ (আদাবুল মুফরাদ : ৩৭৭)।
    অন্ধকার যুগে শিশুদের কোনো জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না। তারা সব অধিকার থেকে ছিলো বঞ্চিত। বিশেষ করে সেই অন্ধকার যুগে কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়া হত এবং কারো ঘরে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে লজ্জাজনক ভাবা হত। ইসলাম দেড় হাজার পূর্বে সর্বাগ্রে শিশুর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না’ (সুরা আনআম : ১৫১)। শিশুরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আরব সমাজে চরম অবহেলিত ও নির্যাতিত শিশুদের তিনি সেরা সম্পদ বলে আখ্যায়িত করেন। তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেন। পবিত্র কুরআন মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘ধনৈশ্বর্য এবং সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য।’ (সুরা কাহাফ : ৪৬)।
    ইসলাম শান্তির ধর্ম। রাসুল (সাঃ) এই সাম্যের শিক্ষা ও চর্চাকে সবক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমনকি সে যুগের শিশু সন্তানদের চরম দুর্গতি থেকে উদ্ধার করে তাদের মাঝে সমতা বিধান করেন। হাদিসে বর্ণিত, এক ব্যক্তি দু সন্তানের একজনকে চুমু দিলেন, অন্যজনকে দিলেন না। রাসুল (সাঃ) তাৎক্ষণিক তাকে বললেন, ‘তুমি উভয়ের মাঝে সমতা বিধান করলে না। (বোখারী শরীফ)। ইসলাম এভাবেই আদর, স্নেহ এমনকি চুমুর ব্যাপারেও সমতার নির্দেশ দেয়। হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একবার এক ব্যক্তি নবী কারিম (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। লোকটির সঙ্গে  একটি শিশুও ছিলো। নবীজী লোকটিকে বললেন, ‘তুমি কি এই শিশুর প্রতি দয়া করো? তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলেন। প্রিয় নবীজি বললেন, ‘তাহলে এই শিশুর প্রতি তুমি যতটুকু দয়া করবে তারচে বেশি আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া করবেন। তিনি দয়ালুর মধ্যে সবচেয়ে বড় দয়ালু।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ৩৭৭)। অপরদিকে কন্যা সন্তানদের বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করত মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘পর্দানশীন কন্যারাই উত্তম সন্তান। তোমাদের সন্তানদের মধ্যে মেয়েরাই উত্তম। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সৌভাগ্যবান, যার প্রথম কন্যা সন্তান। যে ব্যক্তি একটি কন্যা সন্তানকে সঠিকভাবে ভরণ-পোষণ করেছে, তার জন্য বেহেশত অবধারিত।’
    শিশুর সুস্থ ও সুন্দর বিকাশ অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে রাসুল (সাঃ) জোর তাগিদ দিয়েছেন। তাদের প্রতি যথাযথ আদর, স্নেহ, মায়া মমতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’ অন্যত্র বলেন, ‘শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করো। তোমরা তাদের সঙ্গে ওয়াদা করলে তা পূর্ণ করো। কেননা, তাদের দৃষ্টিতে তোমরাই তাদের রিজিকের ব্যবস্থা করছো।’ অপর এক হাদিসে হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসুল (সাঃ) তাঁর নাতি হাসানকে চুমু খেলেন। সেখানে আকবা ইবনে হাবিস নামে এক সাহাবী বসা ছিলেন। হাসানকে চুমু খাওয়া দেখে তিনি বললেন, ‘আমার দশটি সন্তান রয়েছে। আমি তাদের কাউকে চুমু খাইনি।’ নবীজী তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে দয়া করে না, তার প্রতিও দয়া করা হবে না।’ (সহীহ বুখারী : ৫৬৫১)। তাই শিশুদের আদর করা, তাদের চুমু খাওয়া নবীজির শিক্ষা, নবীজির চাওয়া।
    ইসলাম মাতা-পিতার প্রতি যে দায়িত্ব বেঁধে দিয়েছে তা পালন করার জন্য প্রথমে মাতা-পিতাকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতার দিক থেকে যোগ্য করে তোলার প্রতিও নির্দেশ প্রদান করেছে। যে শিশুটি এসে আপনার ঘরে জন্ম নিলো, তার মনে, তার দেহে আপনার চরিত্রের প্রভাব, রুচির প্রভাব পড়তে বাধ্য। অতএব, আপনি যদি আদর্শ পিতা হন, আদর্শ মাতা হন, তাহলে প্রথমে আপনাকে হতে হবে সংযমী, পরিত্রমনা, উচ্চাকাক্সক্ষী আর সুবিবেচনার অধিকারী। ভয়, ক্রোধ, ঈর্ষা তথা আবেগজনিত আচরণ মারাত্মকভাবে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন করে। এজন্য শিশুদের মারধর করা, ভয় দেখানো অথবা এমন কোনো আচরণ করা যাতে তার ক্রোধ বাড়ে বা হিংসাবোধ সৃষ্টি হয়, তা থেকে নিরাপদ থাকা মাতা-পিতার দায়িত্ব। শিশুর আচরণ গঠনে সামাজিকতা ও পরিবেশ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। শিশুর পরিবেশ অর্থাৎ তার আশেপাশের ঘটনা ও জিনিসের মধ্য দিয়েই শিশুর অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ও পুষ্টি হয়। তাই মাতা-পিতার উচিত শিশুর মেজাজ, আগ্রহ ও প্রবণতার সঙ্গে পরিবেশ ও সামাজিক আচরণের সমন্বয় সাধন করা। শিশুর স্বাধীনতা ইচ্ছা, ভালোবাসা, নিরাপত্তাবোধের আকাক্সক্ষা, প্রতিরোধের বাসনা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেই তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। তাকে স্নেহ-ভালোবাসা প্রদান এবং তাকে নৈতিক শিক্ষা দেয়া অতীব জরুরী। সন্তানের সামনে ধূমপান করা যাবে না। কারণ এতে সন্তান ধূমপানের প্রতি ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়ে। এসব বিষয়ে মাতা-পিতার সচেতন হতে হবে।
    শিশুরা সামাজিক স্তরে এসে প্রতিবেশী, আশেপাশের ঘটনা বা প্রকৃতির আচরণ সম্পর্কে পরিচিত লাভ করে বিধায় এই সময় অত্যন্ত সচেতনতার ও সতর্কতার সাথে শিশুদেরকে প্রকৃত ও সঠিক শিক্ষা বা জ্ঞান প্রদান করাও মাতা-পিতার অন্যতম দায়িত্ব। কোনোভাবে যেন শিশুদের বে-আইনী ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করা, পতিতাবৃত্তি বা অন্যান্য অশ্লিল যৌন তৎপরতায় অপব্যবহার করা থেকে প্রত্যেক লোককে সচেতন থাকতে হবে। শিশুর প্রতি নির্যাতন কিংবা অন্যবিধ নৃশংস, অমানবিক বা মর্যাদাহানিকর কোনো আচরণ বা শাস্তির শিকার যাতে শিশুরা না হয়, সেদিকটায় খুব বেশি খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়াও বেশিরভাগ শিশুরই পুষ্টিকর খাদ্য নেই, নেই শিক্ষার পরিবেশ। স্বাস্থ্য সেবা নেয়ারও সুযোগ নেই। তাদের খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থানের সু-বন্দোবস্ত করতে হবে। তাদেরকে ভালোবাসার ডোরে আবদ্ধ করে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিতে হবে, যাতে তারা হাসি, আনন্দে, গানে ও খুশিতে প্রজাপতির মতো চঞ্চল হয়ে ওঠে। শিশুরা ফুল হয়ে ফুটে উঠুক সৌরভে। তাদের চাঁদমুখের হাসিতে ভরে উঠুক এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ।
    লেখক : কলাম লেখক।
 

 

সর্বাধিক পঠিত