• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

হত্যার মূল পরিকল্পনকারী অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা

অধ্যক্ষ ফেন্সির খুনি জুলেখার চাচাতো ভাইয়ের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি খুনি ছিলো একাধিক

মুল পরিকল্পনাকারী দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা জহির

প্রকাশ:  ২৬ জুন ২০১৮, ২১:২৬ | আপডেট : ২৭ জুন ২০১৮, ১১:০২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুরে আলোচিত অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি হত্যাকা-ের মূল রহস্য উদ্ঘাটন হতে যাচ্ছে। ফেন্সির মূল খুনিরা আটক হতে শুরু করেছে। যে সরাসরি এ কিলিং মিশনে অংশ নিয়েছে এমন একজন খুনি আটক হওয়ার পরই এ রহস্যজনক হত্যাকা-ের জট খুলতে শুরু করেছে। আটক খুনি রাকিবুল হাসান রাকিব (২৩) আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। রাকিব অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমের চাচাতো ভাই। জুলেখার প্ররোচনা এবং নির্দেশেই খুনিরা অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সিকে খুন করে। খুনি রাকিবের সাথে তার আরেক চাচাতো ভাই লিমনও হত্যাকা-ের সময় ছিলো। আটক রাকিব গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে চাঁদপুরের অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ কায়সার মোশারফ ইউছুফের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ জবানবন্দিতে রাকিব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। রাকিবের বাড়ি মতলব উত্তর উপজেলার ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নের রাঢ়িকান্দি গ্রামে। তার পিতার নাম আব্দুল্লাহ আল-মামুন। সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র। রাকিবকে গত রোববার ঢাকা থেকে আটক করা হয় বলে জানা গেছে।


রাকিব আদালতে এই কিলিং মিশনের যে বর্ণনা দিয়েছে তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, রাকিব তার আরেক চাচাতো ভাই লিমনসহ ঘটনার দিন (২৪ জুন) ইফতারের পর পরই অধ্যক্ষ শাহীন সুলতানা ফেন্সির ষোলঘরস্থ বাসায় যায়। তারা বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামের খোঁজ করেন এবং অধ্যক্ষ ফেন্সিকে বলেন, তারা বিদেশ যাওয়ার কাগজপত্র অ্যাডঃ জহিরকে দেখাতে এসেছেন। ফেন্সি তখন অ্যাডঃ জহির বাসায় নেই বলার পরপরই খুুনিরা অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় বাসার ওয়াশরুম (টয়লেট) ব্যবহার করার জন্যে অনুমতি চায়। তাদের একজন নিজেকে মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেয়। তখন অধ্যক্ষ ফেন্সি তাদের ভেতরে ঢুকার অনুমতি দিয়ে বলেন, আমার মেয়েও ডাক্তার। অধ্যক্ষ ফেন্সি তাদেরকে বলেন, তোমরা ইফতার করেছো? তারপর বলেন, ডাইনিংয়ে খাবার আছে খেয়ে নাও। দুই খুনি তখন ডাইনিং টেবিলে বসে খেজুর খায়। অধ্যক্ষ ফেন্সি তাদেরকে আপ্যায়ন করাতে থাকেন। এ সময়ই সুযোগ বুঝে এক খুনি বাসার তালা দিয়ে অধ্যক্ষ ফেন্সির পেছন থেকে তার মাথার পেছনে আঘাত করলে তিনি সাথে সাথে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। এরপর দুজনে মিলে তালা দিয়ে একের পর এক মাথায় আঘাত করে এবং বাসার ফল কাটার চাকু দিয়ে মাথায় আরো কয়েকটি আঘাত করে। তারা ফেন্সির হত্যা নিশ্চিত করতে পলিথিন দিয়ে মুখ চেপে ধরে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর খুনিরা বাসার বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বাসা থেকে বের হয়ে লঞ্চঘাট চলে যায়। এদিকে ঘটনার সময় খুনি রাকিবের হাত কেটে যায়। তারা লঞ্চঘাট থেকে ব্যান্ডেজ ক্রয় করে। দুই খুনি সে রাতেই এমভি ইমাম হাসান লঞ্চে ঢাকা চলে যায়। ঢাকা থেকে পরে লিমন চাঁদপুর চলে এলেও রাকিব চলে যায় গাজীপুর। খুন করার পর থেকে এই দুই খুনি কেউ কারো সাথে মোবাইলে আর যোগাযোগ করে নাই। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে আটক করা হয় খুনি রাকিবকে। পুলিশ জানিয়েছে, অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাই ফেন্সি হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী। ঘটনার পর পুলিশ যে জুলেখার মোবাইল জব্দ করেছিলো, সেখানে দেখতে পান রাকিব এবং লিমন ঘটনার দিন জুলেখার সাথে মোবাইলে একাধিকবার কথা বলেছে। এ সূত্র ধরেই ডিবি পুলিশ খুনিদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়।

 


আরো জানা যায়, ঘটনার দিন সকালে দুই খুনির একজন ঢাকা থেকে আরেকজন মতলব উত্তর থেকে চাঁদপুর আসে। তারা শহরের হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে খুনের পরিকল্পনা করতে থাকে। ইফতারের পর পরই দুই খুনি কিলিং মিশনে যায়। খুনি রাকিবের সাথে জুলেখা বেগমের নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। তারা মোবাইলে নিয়মিত কথা বলতো। জবানবন্দিতে রাকিব জুলেখার কথা বললেও অ্যাডঃ জহির প্রসঙ্গে কিছু বলেছে কি-না, তা জানা যায়নি।

 


পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকা-ের সাথে অ্যাডঃ জহিরের সম্পৃক্ততা কতোটুকু তা নিশ্চিত করার জন্যে আরো ব্যাপক তদন্ত প্রয়োজন। এ খুনের সাথে সর্বমোট কতোজন জড়িত তা এখনো নিশ্চিত করে বলেনি পুলিশ।

 


মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশ পরিদর্শক মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, তদন্তের স্বার্থে অনেক কথাই বলা যাচ্ছে না। তবে মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হয়েছে। বাকী আসামীদেরও দ্রুত সময়ে আটক করা সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান।

 


উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ফরিদগঞ্জের গল্লাক আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি গত ৪ জুন সোমবার রাত সাড়ে ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে যে কোনো সময় খুন হন। চাঁদপুর শহরের ষোলঘর এলাকার শেখ বাড়ি রোডস্থ নিজ বাসার ভেতরে এ খুনের ঘটনা ঘটে। ওই রাতেই সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনা জানাজানি হয়। অধ্যক্ষ ফেন্সির স্বামী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডঃ জহিরুল ইসলাম জামাতে এশা ও তারাবীহর নামাজ শেষ করে বাসায় ঢুকে ফ্লোরে তার স্ত্রী ফেন্সির রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এরপরই ঘটনা জানাজানি হয়। অ্যাডঃ জহির ঘটনাস্থলে থেকেই তার আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী আইনজীবী ও জেলা আওয়ামী লীগের ক'জন শীর্ষ নেতাকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানান। সাথে সাথেই তারা ঘটনাস্থলে যান। খবর পেয়ে মডেল থানার পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও পিবিআইও ঘটনাস্থলে যায়। নিহত ফেন্সির ভাইয়েরাও ঘটনাস্থলে যান। শত শত মানুষ সেখানে জমে যায়। এক পর্যায়ে অ্যাডঃ জহিরের পরিবার ও অধ্যক্ষ ফেন্সির পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা দেয়া দেয়। তখন নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি সামাল দেন। ডিবি পুলিশ পরে অ্যাডঃ জহিরকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে সে রাতেই অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগমকে নাজির পাড়াস্থ ভাড়া বাসা থেকে ডিবি পুলিশ আটক করে। ঘটনার পরদিন ৫ জুন অধ্যক্ষ ফেন্সির ভাই মোঃ ফোরকান উদ্দিন খান অ্যাডঃ জহিরকে প্রথম ও জুলেখাকে দ্বিতীয় আসামী করে মোট চারজনের বিরুদ্ধে চাঁদপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। অপর দুই আসামী হচ্ছেন অ্যাডঃ জহিরের ভাই ও এক বোন। ৫ জুন অ্যাডঃ জহির ও জুলেখাকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায়। চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর এ মামলার তদন্তভার দেয়া হয় জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশকে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হচ্ছেন জেলা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মোঃ মহিউদ্দিন।

 


এদিকে ঘটনার দিন (৪ জুন) রাতেই খবর পেয়ে অ্যাডঃ জহির ও ফেন্সি দম্পতির ছোট মেয়ে ডাঃ পুষ্প কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর ছুটে আসে। আর তাদের বড় মেয়ে পদ্ম ৬ জুন ইতালি থেকে চাঁদপুর আসার পর এদিন বাদ এশা নিহত ফেন্সির জানাজা নামাজ শেষে ফেন্সিদের পুরাতন বাড়ি মৈশাদী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন খান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। এদিকে ঘটনার পর থেকেই নিহত ফেন্সির ভাইয়েরা এবং ফেন্সির মেয়েরা এ হত্যাকা-ের ব্যাপারে অ্যাডঃ জহির ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাকে দায়ী করে আসছেন। এমনকি অ্যাডঃ জহিরই খুন করেছে এমন দাবিও করা হয়। তবে অ্যাডঃ জহির আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে এবং তার স্ত্রী হত্যার বিচার যেনো তিনি দেখে যেতে পারেন আদালতের কাছে এ আকুতিও তিনি করেছেন। এখন মূল খুনিরা আটক হতে থাকায় ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

 

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ