• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কোভিড-১৯: যেসব বিষয়ে সতর্কতা জরুরি

প্রকাশ:  ২৮ মার্চ ২০২০, ১০:২৯
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস) একটি নতুন প্রজাতির ভাইরাস, যা চীনের উহান শহর থেকে পর্যায়ক্রমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এর সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও প্রস্তুত নয় এর মোকাবিলায়। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীন তাদের সর্বপ্রথম কেস ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের (WHO) নজরে আনে। এর মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ভাইরাসটি যে এভাবে বিস্তার লাভ করবে, তা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

জিনতত্ত্বগতভাবে, কোভিড-১৯ একটি RNA ভাইরাস। এর আগে আরও ছয় প্রকারের করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমাদের জানা থাকলেও এর কোনোটি এই মাত্রায় সংক্রমণ ঘটায়নি। কোভিড-১৯ মূলত আমাদের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। অসুখটির প্রকৃত নাম হলো Acute Respiratory Syndrome Coronavirus-2 (SARS-CoV-2)। এর আগে আমরা ২০০২ সালে সার্স (SARS) এবং ২০১২ সালে মার্স (MERS)–এর প্রাদুর্ভাব দেখেছি, যা ভিন্ন প্রজাতির করোনাভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত হয়েছে। কিন্তু তার বিস্তৃতি এই মাত্রায় ছিল না।

এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়েও এখনো মতবিরোধ আছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাসটি খুব সম্ভবত বাদুড়ের শরীরে যে করোনাভাইরাস থাকে, সেখান থেকে (জিনতত্ত্বগত মিল ৮৯-৯৬%) মালায়ান প্যানগোলিন নামক আরেকটি প্রাণীর মাধ্যমে (জিনতত্ত্বগত মিল ৯১%) অবশেষে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, এই ভাইরাসের বাহক এখন মানুষ, অন্য কোনো প্রাণী নয়। কাজেই অজ্ঞতাবশত কোনো প্রাণী হত্যা বা নিগৃহীত করার মতো ঘটনা যেন আমরা না ঘটাই।

এখন পর্যন্ত এই রোগের লক্ষণগুলো সম্পর্কে আমরা যা জানি তা হলো কফ, জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, ডায়রিয়া ও বমি। মূলত ফুসফুস আক্রান্ত করে সাধারণ ফ্লুর মতো উপসর্গ থেকে নিউমোনিয়া বা রেসপিরেটরি ফেইলিউরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় অল্প সময়ে। সমস্যা হলো এর সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি এখনো জানা যায়নি। এ কারণে কোন চিকিৎসা কার্যকর আর কোনটি নয়, তা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, রোগটি এতই ছোঁয়াচে যে একসঙ্গে অনেকজন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসছে। আর একসঙ্গে এত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা মুশকিল। ইউরোপ আর আমেরিকার মতো দেশগুলো এ কারণেই সামাল দিতে পারছে না। এখন পর্যন্ত আমরা জানি, যেসব রোগীর অন্যান্য সমস্যা রয়েছে, যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার বা বিভিন্ন কারণে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, এই ভাইরাস তাঁদের বেশি কাবু করে ফেলে। বয়স্ক মানুষের মধ্যে তাই মৃত্যুহারও বেশি। তবে কমবেশি সবারই আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী কারও একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

ফুসফুস আক্রান্ত করার পাশাপাশি এই ভাইরাস হার্টের সমস্যাও করতে পারে। স্বল্প পরিসরে এ বিষয়েই আজ কিছু তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরব।

এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৭ থেকে ২২ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ হার্টের সমস্যা ঘটিয়েছে। বিশেষ করে যেসব রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে গিয়েছে, তাদের প্রায় চারজনের মধ্যে একজনের হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে কোভিড-১৯ এর জন্য। ধারণা করা হয়, যে রিসেপ্টরের মাধ্যমে ভাইরাসটি ফুসফুসের কোষের মধ্যে ঢোকে, সেই একই রিসেপ্টরের (ACEi) মাধ্যমেই এটি হার্টের মাসলে প্রবেশ করে। ফলে দেখা দিতে পারে অ্যাকিউট কার্ডিয়াক ইনজুরি। এ ছাড়া হতে পারে ফালমিনেন্ট মায়োকার্ডাইটিস (হার্টের মাসলের প্রদাহ) অথবা স্ট্রেস ইনডিউসড কার্ডিওমায়োপ্যাথি (Takotsubo Cardiomyopathy)। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত রোগী অ্যাকিউট মাইয়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের (হার্ট অ্যাটাক) মতো ব্যথা এবং ইসিজি পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কিন্তু এনজিওগ্রাম করে কোনো ব্লক পাওয়া যায়নি। এসব রোগীর রক্ত পরীক্ষায় কার্ডিয়াক বায়োমার্কার (Troponin) উচ্চ মাত্রায় ছিল। ইকোকার্ডিওগ্রামে হার্টের দুর্বল কার্যক্ষমতা (Low Ejection Fraction) দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো ভাইরাসজনিত হার্ট মাসল ইনজুরি। উপরিউক্ত যেকোনো হার্টের সমস্যাই বিভিন্ন রকম অ্যারিদমিয়ার (হার্টের অস্বাভাবিক গতি) কারণ হতে পারে।

একটি জিনিস আলোচনায় এসেছে যে অনেক হৃদরোগী ব্লাড প্রেশারের জন্য বা হার্ট ফেইলিউরের জন্য ACEi/ARB জাতীয় ওষুধ (লিসিনোপ্রিল, বেনাজাপ্রিল, রেমিপ্রিল, লোসারটান, ইরবেসারটান ইত্যাদি) খান এবং এই ওষুধগুলো কোষের সেই রিসেপ্টরের ওপর কাজ করে, যে দিক দিয়ে করোনা কোষে ঢোকে। কাজেই এই ওষুধগুলো কি করোনার ঝুঁকি বাড়ায় বা কমায়? এখন পর্যন্ত এ রকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, যা থেকে বলা যায় এগুলো খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকি কমায়। কাজেই যাঁরা এগুলো স্বাস্থ্যগত কারণে খাচ্ছেন, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া বন্ধ করবেন না।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ফালমিনেন্ট মায়োকার্ডাইটিসের ক্ষেত্রে স্টেরয়েডের কোনো ভূমিকা আছে কি না? এখন পর্যন্ত স্টেরয়েডের সপক্ষ কোনো জোরালো তথ্য পাওয়া যায়নি। মনে রাখতে হবে, এর আগে অন্যান্য করোনাভাইরাসজনিত অসুখের (SARS, MERS) ক্ষেত্রে স্টেরয়েড মৃত্যুহার বাড়িয়েছে, কমায়নি। কাজেই কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে ব্যবহারের আগে সবকিছু বিবেচনায় নেওয়া শ্রেয়।

আরেকটি জরুরি ব্যাপার সবার জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন জাতীয় ওষুধের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে কিছু আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এসব অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের তথ্য–উপাত্ত। কাজেই এই আশানুরূপ ফল হতে পারে আপেক্ষিক এবং সব ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে একই ফল না–ও পাওয়া যেতে পারে। পক্ষান্তরে, এই ওষুধগুলোর রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কখনো কখনো এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টও (Torsades De Pointes) হতে পারে। কাজেই ঘুণাক্ষরেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এসব ওষুধ ব্যবহার করার কথা চিন্তা করবেন না।

সর্বশেষে, এটি একটি নতুন ভাইরাস, যা আমাদের এখনো অজানা। সামনের দিনগুলোতে আরও সমন্বিত তথ্য হয়তো পাওয়া যাবে। এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো সংক্রমণ প্রতিরোধ করা। কাজেই সাবধান থাকুন, যত দূর সম্ভব ঘরে থাকুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।

মাশরাফী আহমেদ, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ
ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বে-স্টেট হসপিটাল, ম্যাসাচুসেটস, ইউএস
ই–মেইল: [email protected]

সর্বাধিক পঠিত