• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

করোনায় দেশে ফিরেছেন ৮ লাখ প্রবাসী

প্রকাশ:  ২২ মে ২০২০, ১৭:৫৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

>> অর্থনীতির সবচেয়ে সুবিধাজনক সূচক রেমিট্যান্সও নিম্নমুখী
>> ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে
>> জুনে বোঝা যাবে রেমিট্যান্সের বাস্তব চিত্র

করোনাভাইরাস মহামারিতে সঙ্কটে পড়েছে গোটা বিশ্ব। তাই এর প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। এ সংখ্যাটা সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। ফলে অর্থনীতির সবচেয়ে সুবিধাজনক খাত রেমিট্যান্সের সূচকটিও নিম্নমুখী হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি কমে যাবে বলে মনে করছে সরকার।

বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তার ওপর একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সরকার। সরকারের এ পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। অর্থ, বাণিজ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্মিলিতভাবে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনা মহামারি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিদেশে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ফলশ্রুতিতে প্রত্যাগত প্রবাসী বাংলাদেশি এবং তাদের পরিবারের উপার্জন অনেকাংশে কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা বাণিজ্যে। চাহিদা কমে গেলে ভোগ্য পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে। করোনা মহামারির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে, অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যাবে। ফলে চলতি বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।

সরকার আরও মনে করছে, অর্থনীতির সবচেয়ে সুবিধাজনক খাত হলো রেমিট্যান্স। করোনা মহামারির কারণে একমাত্র ভালো সূচকটিও নিম্নমুখী হওয়ার পথে। গত জানুয়ারিতে প্রবাসী আয় ৫ কোটি ডলার কমেছে এবং ফেব্রুয়ারিতে তা ১৯ কোটি ডলার কমে গেছে। রেমিট্যান্সের নিম্নগতির প্রবণতা মে-জুন ২০২০ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। ফলে দেশের রিজার্ভ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় বলা হয়- ইতালি, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোতে শ্রম বাজার রক্ষায় সর্বোচ্চ কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি নতুন শ্রম বাজার সন্ধানের কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা দুই ধরনের কাজ করছি। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের চাকরি যাতে থাকে আমাদের দূতাবাসগুলো সে বিষয়ে কাজ করছে। আরেকটা কাজ করছি, যারা বেকার কিংবা অবৈধ তাদের বিষয়ে সেসব দেশের সরকারের সঙ্গে আলাপ করছি যে, তোমরা তাদের একটু সাহায্য দাও সহায়তা পেলে তারা অনেকে কাজ করবে। এতে করে তোমাদেরও লাভ, আমাদেরও লাভ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রবাসীদের বলছি, আপনার একটু কষ্ট হলেও সে দেশেই থাকুন। একেবারে বাধ্য না হলে আসবেন না, সুযোগ নিশ্চয় আসবে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে কি ধরনের শ্রমবাজার রয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে আমরাদের দূতাবাসগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। কোথায় কোথায় নতুন চাকরি পাওয়া যেতে পারে, সে সন্ধানও করা হচ্ছে। তবে হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন চাকরি হচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে আগে যে হারে লোক যেত এখন আর সে হারে সম্ভাবনা নেই। তবে সুখের বিষয় হচ্ছে, আমরা আফ্রিকার কয়েকটি দেশে মনে হয় ৪০ থেকে ৫০ লাখ লোক পাঠাতে পারব। এটা নিয়েও কাজ চলছে।’

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসীদের নিজেদেরই টাকার দরকার, কারণ তাদের কাজ নেই। তারপরও কিছু টাকা পরিবারের জন্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু রেমিট্যান্স পাঠানোর সমর্থটুকু আগামী মাসগুলোতে থাকবে না। কারণ মার্চ মাসে সবাই কাজ করেছে, এপ্রিলে সেই টাকা পাঠিয়েছে। আবার কেউ একটু দেরি করে বেতন পাওয়ায় এপ্রিলের পরেও আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে অনেকেই টাকা পাঠিয়েছে। কিন্তু এপ্রিল মে মাসে সেই অর্থে প্রবাসীদের কাজ নেই, তাই পরের মাসগুলোতে রেমিট্যান্সে আমাদের বড় ধাক্কা খেতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় রিজার্ভ ধরে রাখার বিষয়টি বড় রকমের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কিন্তু এখনও রিজার্ভ পরিমাণ খুব একটা কমছে না। কারণ এখন আমদানির পরিমাণ খুব কম। কিন্তু আমদানি বাড়তে থাকলে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়তে পারে। এই মুহূর্তে অর্থনীতি একটি নিম্ন ভারসাম্য নীতিতে চলছে বলে আমরা খুব বেশি টের পাচ্ছি না। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমতে থাকে আর চাহিদা বাড়ার কারণে আমদানি বাড়তে থাকে, তাহলে আমদানি ব্যয় মেটানোর চাপ আসতে থাকবে।’

এ গবেষক বলেন, ‘আগামীতে আমাদের কর্মী বিদেশে পাঠানোতে যেমন সমস্যা হবে, তেমনই বর্তমানে যারা বিদেশে রয়েছেন তাদের ফেরত আসারও একটা চাপ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসীর মূলত মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক। করোনার কারণে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমে গেছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের পরিধি কমবে। এছাড়া প্রচুর সংখ্যক অবৈধ বাংলাদেশি বিদেশে আছেন, করোনার কারণে তাদেরকে বিভিন্ন দেশ ফেরত পাঠাতে চাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সে আগামীতে বহুমুখী চাপ পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই মনে হয়, আগামী বছরজুড়ে রেমিট্যান্স কমার এ ধাক্কাটা থাকতে পারে।’

এ বিষয়ে সমাধান জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘যদি বিদেশে কাজের সুযোগ না থাকে, তাহলে প্রণোদনা দিয়ে আমরা খুব বেশি রেমিট্যান্স আনতে পারব না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন সে দিকেই যাচ্ছে। যেখানে তাদের নিজেরই আয় নেই, তাই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই এক্ষেত্রে বাইরের দেশগুলোতে আমাদের করণীয় খুব কম। বরং যারা ফিরে আসছে, তাদের ছোট ছোট ঋণ দিয়ে দেশের ভেতরে কাজের সুযোগ করে দেয়া যায় কি না সেটা ভাবতে হবে। একইসঙ্গে বাইরে যারা রয়েছেন তাদেরকে যেন সহসায় দেশে না আসতে হয়, সে জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হবে। অন্তত ন্যূনতম আয় দিয়ে হলেও সেখানে রেখে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

এদিকে ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ে (রেমিট্যান্স) স্বস্তি এসেছে। গত বছর ঈদে প্রবাসীরা যে পরিমাণ আয় পাঠিয়েছিলেন, চলতি বছরে সঙ্কটের মধ্যেও তা খুব বেশি কমেনি। অথচ করোনাভাইরাসের কারণে প্রবাসে থাকা বেশিরভাগ দেশেই লকডাউন অবস্থা চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সঙ্কট চললেও ঈদের কারণে অনেকেই টাকা পাঠাচ্ছেন। অনেক সাহায্যও আসছে। আবার যারা দেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন, তারাও টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ বহন করে বেশি টাকা আনা যায় না। এ জন্য আয় বেড়েছে। সামনের দিনে প্রবাসী আয় পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ১ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ১০৯ কোটি ১০ লাখ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। গত বছর একই সময় এসেছিল ১০৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় যা ৯ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ। প্রবাসী আয়ের এই ধারা এখন পর্যন্ত ভালো।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদের আগে ধার করে হলেও প্রবাসীরা টাকা পাঠিয়ে থাকেন। আবার যারা চলে আসবেন, তারা সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। এসব টাকাই দেশে আসছে। জুন মাসে গিয়ে প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে। প্রবাসী আয় অনেক কমে যাবে।

জানা গেছে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটি ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আসে, সেসব দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রেমিট্যান্স হাউজ ও ব্যাংকগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বাংলাদেশি শ্রমিকেরাও পড়েছেন বিপদের মুখে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের থাকা শ্রমিকেরা। দেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। যদিও সম্প্রতি কিছু দেশে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে।

বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। সে অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে প্রবাসীরা প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে ২ টাকা প্রণোদনা পাচ্ছেন। বাজেটে এ জন্য ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এতে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছিল।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১৯ মে সময়ে এক হাজার ৪৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১৯ মে পর্যন্ত এসেছে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স।

এদিকে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বাজেট সহায়তা হিসেবে ২৫ কোটি ডলার বাংলাদেশকে দিয়েছে। প্রবাসী আয় ও বাজেট সহায়তার টাকা আসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আমদানি দায় শোধ করতে অনেক ব্যাংকে এখনও ডলারের সংকট রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে। এতে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৮২ কোটি ডলার বিক্রি করেছে।