• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

করোনায় শ্লথ অর্থনীতির চাকা গতি পাবে কিভাবে?

প্রকাশ:  ০৩ এপ্রিল ২০২০, ২২:৩৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মাসখানেক আগেও করোনা মহামারি ছিল শুধু চীনকেন্দ্রিক। দেখতে দেখতেই বদলে গেছে পরিস্থিতি। নভেল করোনাভাইরাসের হানায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলো। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সবার মধ্যেই। মহামারি ঠেকাতে যেন মহাচ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন সারাবিশ্বের নীতিনির্ধারকরা। কোনোভাবে হয়তো করোনায় প্রাণহানি ঠেকানো গেল, কিন্তু তাতে কি শেষ হবে এই দুর্ভোগ? বিশেষজ্ঞদের উত্তর, না! অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়েছে গোটা বিশ্বে। একটা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, অর্থনীতি- হুমকির মুখে সবই।

উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে দেশে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এসবের কার্যকারিতা, নীতিনির্ধারণের সমস্যা প্রভৃতি নিয়ে বিশ্লেষণী প্রতিবেদন করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট। জাগোনিউজের পাঠকদের জন্য তার সার-সংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-

করোনা নীতির বিপত্তি
গত ৩০ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, দেশটিতে সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কিত নির্দেশনা এপ্রিলের শেষ অবধি কার্যকর থাকবে। তাদের নীতিনির্ধারণী মডেল অনুসারে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুহার আগামী দু'সপ্তাহেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে না। এতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, যদি খুব কড়াকড়িভাবে কেন্দ্রীয় নির্দেশনাগুলোর সবই অনুসরণ করা হয়, তাহলে দেশটিতে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণরক্ষা হতে পারে।

এ ধরনের মহামারি সংক্রান্ত মডেল বা রোগতত্ত্ব মডেলগুলোর কারণেই মূলত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে, অবশ্য এটাই একমাত্র কারণ নয়। সংক্রমণ শুরুর পরপরই চীনেও অভূতপূর্ব কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এর কারণেই সেখানে সংক্রমণের ঘটনা আশ্চর্যজনক হারে কমে এসেছে।

এ ধরনের মডেলের বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি বিভিন্ন দেশে কী হচ্ছে বা আগামীতে কী হতে চলেছে তার একটা আনুমানিক চিত্র পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি খারাপ হবে কি-না, হলে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তারও ধারণা পাওয়া যায় এ মডেল থেকে। এগুলো দেখে বিশেষজ্ঞরা খুব সহজেই বলে দিতে পারেন, লকডাউন হলে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচতে পারে। তবে সেটা কীসের বিনিময়ে- এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া একজন নীতিনির্ধারকের জন্য বেশ কঠিন।

আর মহামারি বিশেষজ্ঞরা যখন এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেন, ‘সেটা আমাদের জানার বিষয় নয়’, তখন এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হয় অর্থনীতিবিদদের দিকে। তবে তাদের কাছ থেকে বড় একটা সাহায্য মেলে না। হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য অবশ্যই অর্থনীতিকে বড় মূল্য দিতে হবে; তবে সে বড় আসলে কতটা তার জন্য কিছু প্রশ্নের জবাব জানা প্রয়োজন। যেমন : পরিস্থিতি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো আসলে কতটা কার্যকরী হচ্ছে, এ অবস্থা কতদিন স্থায়ী হবে এবং কিভাবে শেষ হবে।

মহামারির দু’টি মডেল
এপিডেমিওলজিকাল মডেল মূলত দুই ধরনের। প্রথমটিতে রোগ বিস্তারের আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ব্যক্তিকে রোগের বাহক, আক্রান্ত, সংক্রমিত বা রোগমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম অনুসারে প্রতিটি গ্রুপের সংখ্যা অন্য এক বা একাধিক গ্রুপের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

দ্বিতীয় মডেলটি খুব একটা গতিশীল নয়। এটি মূলত চলমান গড়ের একটি পরিশীলিত রূপ, যা পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে কী হতে চলেছে (যেমন, সেখানে কতগুলো নতুন সংক্রমণ হবে) এসবের ভবিষ্যদ্বাণী করে। মূলত, চলতি সপ্তাহে যা যা ঘটছে, গত সপ্তাহে যা ঘটেছে এবং তারও আগে কী হয়েছিল এসবের ওপর ভিত্তি করেই এই মডেলটি করা হয়।

তবে, এ দু’টি মডেলেই কোভিড-১৯ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। কোন বয়সের কত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, কিভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, উপসর্গ প্রকাশের আগে কী অবস্থা থাকে এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণেই করোনা মহামারির বিভিন্ন মডেলের কার্যকারিতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে।

হিসাবের কারসাজি
এটাও একটা সমস্যা। মহামারি শুরুর দিকে নেদারল্যান্ডস নিবিড় পরিচর্যার সময়সীমা ১০ দিন ধরে দেশজুড়ে আইসিইউয়ের ধারণক্ষমতা হিসাব করেছিল। কিন্তু, পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯ মার্চের পর সেই সময়সীমা বাড়িয়ে ২৩ দিন করেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে আগামী ৬ এপ্রিলের মধ্যেই দেশটিতে আইসিইউয়ের ধারণক্ষমতা পূরণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ডাচদের জন্য এ তথ্য আশঙ্কাজনক হলেও স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, একেবারে শেষ সময়ে এসে এটা তাদের জানা লাগেনি। হিসাব কষে আগেভাগেই বিপদের আঁচ করতে পেরেছে তারা।

এ ধরনের মডেল যত বেশি তথ্যসমৃদ্ধ হবে এর কার্যকারিতাও ততটাই বেশি হবে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণের অনুমতি দিলে সেটি আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। মডেলগুলো যত বেশি যাচাই-বাছাই হবে, এর প্রত্যাশিত ফলাফলের অসামঞ্জস্যগুলোও ততটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই সমস্যা দূর করার একটাই উপায়- তুলনামূলক ও ভিন্ন ভিন্ন মডেলের ফলাফল একত্রিত করে হিসাব করতে হবে।

lockdown

এসব বিবেচনা করেই সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বিভিন্ন মডেলের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের টাস্কফোর্সও মডেল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করেছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে চায় দেশটির সরকার।এছাড়া, নিজেদের মহামারি মডেলের খুঁটিনাটি প্রকাশ করেছে নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ডও।

মডেল ভিন্ন, নির্দেশনা একই
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মডেল অনুসরণ করা হলেও প্রায় সবখানেই মহামারি প্রতিরোধে পরামর্শ বা পদক্ষেপ অনেকটা একই। তবে এর মানে এটা নয় যে, সব সিদ্ধান্তই বুদ্ধিমানের মতো হয়েছে। যেমন- ভারত যেভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করছে তাতে সেখানে করোনার হুমকি আরও বেড়ে গেছে।

আবার ব্যতিক্রমও আছে। যেমন- নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনে নিষেধাজ্ঞা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক শিথিল।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন বা এ ধরনের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে- মহামারির প্রকোপের চেয়ে সেসব পদক্ষেপের ক্ষতিই বেশি হতে পারে বলে বিতর্ক রয়েছে।

ভয়ঙ্কর করোনা
করোনার হানায় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ থাবা পড়েছে মানবজীবনের ওপর। যুদ্ধের মতোই সরাসরি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে করোনাভাইরাস। ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার লাখো মানুষের প্রাণরক্ষার কথা বলছেন। তবে তাকেও স্বীকার করতে হয়েছে, দেশটিতে এবারের মহামারিতে এক থেকে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যা ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত মার্কিন সেনা সংখ্যার চেয়েও অনেক অনেক বেশি।

আবার, কোনো দেশ নাগরিকদের স্বাস্থ্যের চেয়ে অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করলেও তাতে শেষ পর্যন্ত খুব একটা লাভ হবে না। বাধ্যতামূলক নীতিমালার অভাবে অনেকেই ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ির বাইরে কাজে যোগ দেবে না বা কাজের সময় কমিয়ে দেবে। যেমন- দক্ষিণ কোরিয়ায় সিনেমা হলগুলো খোলা রয়েছে। তবে করোনার ভয়ে ঠিকই দর্শকশূন্য সেগুলো। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান কঠোরভাবে উৎপাদন চালানোর চেষ্টা করলেও যথারীতি সেখানকার কিছু কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, বাকিরা কাজ থেকে দূরেই থাকছেন।

সুতরাং, কর্মী ও তাদের পরিবারের জীবন বাঁচানো শুধু মানবিকভাবেই জরুরি নয়, এর অর্থনৈতিক সুবিধাও রয়েছে।

লাভ-ক্ষতির হিসাব
১৯৭০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ইউরোপে অর্থনৈতিক তৎপরতা এবং মৃত্যুহারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেখানে বেকারত্বের হার এক শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ৬৫ বছরের কম বয়সী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার হার ০.৭৯ শতাংশ বেড়ে গেছে। বেড়েছে হত্যাকাণ্ডের হারও। ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক ক্রিস্টোফার রুহমের ২০০০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার এক শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মৃত্যুহারের মধ্যে প্রোসাইক্লিক্যাল সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানবস্বাস্থ্যের ওপর মন্দা নীতিমালার প্রভাবও অনেকটা বেড়ে গেছে।

আসবে নতুন দিন
ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের সের্জিও কোরি, নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের স্টিফান লাক এবং এমআইটির এমিল ভার্নারের সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, তারা ১৯১৮-১৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ফ্লু মহামারির প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন, কোনো শহরে যত বেশি সময় ধরে মহামারি চলেছিল, পরবর্তীতে সেখানকার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ততটাই ভালো হয়ে ওঠে। ওমিং ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদদের সাম্প্রতিক গবেষণায় বর্তমান প্রেক্ষাপটেও একই সম্ভবনা দেখা গেছে।

এক্ষেত্রে বিশ্বের কিছু জায়গায় অর্থনৈতিক চাপ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। গোল্ডম্যান স্যাশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি বছরের শেষের দিকে ইতালির ঋণ দেশটির জিডিপির ১৬০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এটি বন্ড মার্কেটের জন্য যথেষ্ট আতঙ্কের বিষয়। এই সংকট কাটাতে ইতালির ঋণকে সব সদস্য দেশের দায়বদ্ধতায় পরিণত করতে পারে ইউরো জোন। অবশ্য ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। তারা সীমিত পরিমাণে ইতালিয়ান বন্ড কিনে রাখছে। তবে এতে আপত্তি আছে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের। সেক্ষেত্রে এমন একটি সময় আসতে পারে, যখন ইতালি ইউরো ছাড়ার পরিবর্তে অন্য কোনো দেশের ওপর তাদের বিধিনিষেধ শিথিল করতে বাধ্য হবে।

দুশ্চিন্তা আছে আরও একটি বিষয়ে। অর্থনীতি যত বেশি দিন চাপে থাকবে, এর ক্ষতি ততটাই দীর্ঘস্থায়ী হবে। দীর্ঘদিনের বেকারত্বে ভোগা শ্রমিকদের দক্ষতা কমে যেতে পারে, কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে তাদের সংযোগ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে মন্দা শেষ হলেও পরে তাদের ভালো কাজ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যেতে থাকে। প্রবীণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। তাদের ফের কাজে যোগদানের সুযোগ বা সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়, অনেকেই দ্রুত অবসরের কথা ভাবতে শুরু করেন। সুতরাং, দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে যে প্রভাব পড়বে, তা একসময় চিরস্থায়ী ক্ষতচিহ্নে পরিণত হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, মহামারি শেষে বেশি বেশি শ্রমিককে কাজে ফেরানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সংকট দূর করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে, কোনো দেশ যদি নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করে দেখে তাদের অর্থনীতি আগের মতোই সচল হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি সংক্রমণের হারও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে শিগগিরই আরও অনেক দেশই তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করবে।