• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

হায়রে মানবতা!

করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে এক নারী কবর খোঁড়ার লোক একমাত্র পুলিশ আর সাংবাদিক

প্রকাশ:  ০৩ মে ২০২০, ১১:২৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মানুষ যে এতোটা নির্দয়, নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাবতেও শরীর কাঁটা দিয়ে যায়। একজন মানুষ মারা গেছে, তার জন্যে শেষ ঠিকানা সাড়ে তিন হাত দৈর্ঘ্যের মাটির ঘর পিতৃভূমিতে হবে না! এমন নিষ্ঠুরতম আচরণের কথা কি ভাবা যায়? তাও আবার এমন কথা শুনতে হচ্ছে বাড়ির মানুষ থেকে। যদিও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু তা তিনি অস্বীকার করেছেন। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হস্তক্ষেপে মৃত ব্যক্তির শেষ ঠিকানা তার পিতৃভূমিতেই হয়েছে। আরো কী নির্মমতা! কবর খোঁড়ার কোনো লোক নেই। তাই কবর খুঁড়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা এবং একজন সাংবাদিক। জানাজা দিয়েছেন নির্ধারিত মাওলানা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং ওই সাংবাদিকসহ হাতেগোনা ক'জন। আর কেনো এতো নিষ্ঠুরতম আচরণ! কেনই বা এতো ভীতি! তার কারণ হচ্ছে মৃত ব্যক্তি করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এ জন্যই তার প্রতি এমন নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা।


ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার দিবাগত রাতে। পুরো ঘটনা শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টা থেকে শুরু করে সেহরীর সময় পর্যন্ত। ঘটনার শুরু চাঁদপুর শহর থেকে, শেষ হয়েছে হাজীগঞ্জের পূর্ব রাজারগাঁও গ্রামে। আলোচিত এই হতভাগী মৃত মানুষটি হচ্ছেন দুই সন্তানের জননী ফাতেমা বেগম (৪৫)। তার পৈত্রিক বাড়ি পূর্ব রাজারগাঁও গ্রামে হলেও তিনি থাকতেন চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোডস্থ মুন্সী বাড়িতে ভাড়া বাসায়। এ বাসায় থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন। তার অসুস্থতা ছিলো জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। রাত ৮টার সময় ফাতেমা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আসলে কর্মরত চিকিৎসক তার মাঝে করোনার উপসর্গ দেখতে পেয়ে তাকে আইসোলেশনে ভর্তি করে দেন। ভর্তি হওয়ার দেড় ঘণ্টার মাথায় ফাতেমা মারা যান। এই খবর সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পরে ফাতেমার স্বজনরা হাসপাতালে আসতে থাকেন।

 


ফাতেমার ভাইয়ের সাথে শুক্রবার রাত ১১টার দিকে কথা বলে জানা গেছে, ফাতেমা চাঁদপুর শহরে একাই থাকতেন, পাশে তার আরেক বোন থাকতো। তার স্বামী জাহাঙ্গীর অনেক আগে মারা গেছেন। তার সন্তানদের বয়স যখন ৭/৮ বছর, তখন জাহাঙ্গীর মারা যান। ফাতেমার ১ ছেলে ১ মেয়ে। তারা উভয়েই বিবাহিত এবং তারা তাদের সংসার জীবন নিয়ে আছেন। মার মৃত্যুর খবর শুনে ছেলে কাছাকাছি থাকায় আসতে পারলেও মেয়ে থাকেন চট্টগ্রামে। তাই তিনি আর আসতে পারেন নি।

 


এদিকে হাসপাতালে থেকেই ফাতেমার ভাই ও বোনরা ফাতেমার লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়ার কথা জানান সে সময়ে হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক আরএমও ডাঃ সুজাউদ্দৌলা রুবেলকে। তখন ডাঃ রুবেল সদর ইউএইচএফপিও ডাঃ সাজেদা বেগম পলিনের সাথে যোগাযোগ করে লাশ নেয়ার জন্যে নিয়ম অনুযায়ী যে ব্যবস্থাপনা আছে তা ঠিক করেন। এমনকি লাশ ধোঁয়া, জানাজা দেয়া ও দাফন কাফন করানোর জন্যে নির্ধারিত লোকসহ সব ব্যবস্থা ডাঃ রুবেল এবং ডাঃ পলিন করে দেন।

 


এরই মধ্যে ফাতেমার ভাই-বোনের কাছে খবর আসে তাদের গ্রামের বাড়ির কিছু লোক এবং রাজারগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাদী ফাতেমার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিতে এবং দাফন করতে দিবে না। এটা নিয়েই অনেকক্ষণ যাবৎ নানা কথাবার্তা চলতে থাকে। এরই মধ্যে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশের সহযোগিতা চাওয়া হয়। থানা থেকে আশ্বস্ত করা হয় সহযোগিতা করা হবে। এসব করতে করতে অনেক সময় গড়াতে থাকে। ডাঃ রুবেলসহ অন্য ডাক্তাররাও লাশ হস্তান্তর করা ছাড়া যেতে পারছেন না। পরে রাত প্রায় ১টার সময় লাশ নিয়ে শহরের বাসস্ট্যান্ডস্থ কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া হয় হাসপাতাল থেকে। বাড়ির লোকজনের বাধার মুখে ফাতেমার লাশ আর গ্রামের বাড়িতে না নিয়ে চাঁদপুর পৌর কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারপরও পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বশেষ চেষ্টা চলতে থাকে ফাতেমাকে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা যায় কি না। এ অবস্থার মধ্যেও প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় চলে যায় বাসস্ট্যান্ড এলাকায়।

 


এদিকে এতো গভীর রাতে আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডঃ জিল্লুর রহমান জুয়েলের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কিউআরসির অন্যতম কর্ণধার নাজমুল হাসান বাঁধন ঘটনাস্থলে পেঁৗছে যায় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার জন্যে। সহযোগিতা দেয়াও হয়েছে কিউআরসির পক্ষ থেকে। ফাতেমার স্বজনদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে যানবাহনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। অথচ তখন কোনো সিএনজি অটোরিকশা তাদেরকে নিতে রাজি নয় নি।

 


রাত দুইটার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) মোঃ আফজাল হোসেনের সহযোগিতার আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ফাতেমার লাশ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ তখনও ফাতেমার জন্য কবর খোঁড়া হয় নি। কোনো জনমানব নেই, এমনকি ইউপি চেয়ারম্যান এবং এলাকার মেম্বারও নেই। শেষ পর্যন্ত এলাকার মেম্বারকে ঘুম থেকে তুলে কবর খোঁড়ার জন্য কোদাল, শাবলসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি আনা হয়। এখন কবর খুঁড়বে কে? লোক তো নেই। অগত্যা হতভাগী ফাতেমার কবর খুঁড়লেন পুলিশ কর্মকর্তা আফজাল, হাজীগঞ্জ থানার সাব-ইন্সপেক্টর জয়নাল আবেদীন এবং হাজীগঞ্জের সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সিফাত। এই তিনজনে কবর খুঁড়ে শেষ করে ফাতেমার জানাজা এবং দাফন কাজ যখন শেষ করলেন, তখন ফজরের আজান শোনা গেলো। অথচ তখনও তাঁদের কেউই সেহরী খান নি। সেহরী না খেয়েই পুলিশ, সাংবাদিকসহ অন্যরা রোজা রাখলেন।

 


এদিকে ফাতেমার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিতে নিষেধ করার বিষয়ে কথা হয় রাজারগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ আব্দুল হাদীর সাথে। তিনি বলেন, অভিযোগটি সঠিক নয়। মৃত ফাতেমার বাড়ির লোকজন আপত্তি করেছে তার লাশ বাড়িতে না নেয়ার ব্যাপারে। এ বিষয়ে তারা আমাকে ফোন করে বলেছে যে, এরা (ফাতেমার) কেউ এ বাড়িতে থাকে না। তার লাশ এখানে কেনো দাফন করা হবে? বাড়ির লোকজনের এ অভিযোগের বিষয়টি আমি হাজীগঞ্জ থানার ওসি এবং চাঁদপুর থানার ওসির সাথে বলি। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) আফজাল সাহেব আমাকে ফোন করেন। তখন আমি তাঁকে বলেছি বাড়ির লোকজন যদি আপত্তি না করে তাহলে আমার তো কোনো সমস্যা নেই। তখন আফজাল সাহেব দায়িত্ব নিয়ে ফাতেমার দাফন কাজ সম্পন্ন করেন এবং আমার পক্ষ থেকে স্থানীয় মেম্বার সেখানে উপস্থিত থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেন।

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ